বিবর্তন রিপোর্ট:
ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে ১ লাখ ৫০ হাজার ৪৭৫ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান।ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে সোমবার (২৭ মে) বিকেলে সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে তিনি এ কথা জানান।তিনি জানান, ১৯ জেলায় ৩৭ লাখ ৫৮ হাজার ৯৬ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আর এক লাখ ৫০ হাজার ৪৭৫ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত।
ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রত্যেক মন্ত্রণালয় থেকে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে অতিদ্রুত তাদের সহায়তা দেওয়া হবে। প্রতিমন্ত্রী জানান, এ পর্যন্ত মোট ১০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে খুলনায় একজন, সাতক্ষীরায় একজন, বরিশালে তিনজন, পটুয়াখালীতে একজন, ভোলায় তিনজন, চট্টগ্রামে একজনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। ঘর, গাছ ও দেয়াল চাপা এবং পানিতে ডুবে এদের মৃত্যু হয়েছে। আর মোট ১৯টি জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলাগুলো হচ্ছে- খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা, ভোলা, ফেনী, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নড়াইল, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর ও যশোর।
ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলার সংখ্যা ১০৭ এবং ইউনিয়ন ও পৌরসভার সংখ্যা ৯১৪। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৩৭ লাখ ৫৮ হাজার ৯৬ জন। সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে ৩৫ হাজার ৪৮৩টি ঘরবাড়ি এবং আংশিকভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে এক লাখ ১৪ হাজার ৯৯২টি ঘরবাড়ি। ঘূর্ণিঝড় সতর্কবার্তার পরিপ্রেক্ষিতে উপকূলীয় এলাকাসমূহে নয় হাজার ৪২৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্র ও স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আট লাখের বেশি লোক আশ্রয় নিয়েছে। গরু-মহিষ, ছাগল-ভেড়াসহ আশ্রিত পশুর সংখ্যা ৫২ হাজার ১৪৬টি। দুর্গত লোকজনকে চিকিৎসা সেবা দিতে মোট এক হাজার ৪৭১টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে, যার মধ্যে চালু আছে এক হাজার ৪০০ টিম।
প্রতিমন্ত্রী জানান, দুর্যোগকবলিত মানুষের সাহায্যে আমরা ইতোমধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছি। ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের অনুকূলে ছয় কোটি ৮৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে ১৫টি জেলায় জিআর (ক্যাশ) তিন কোটি ৮৫ লাখ নগদ টাকা, পাঁচ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন চাল, পাঁচ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, শিশু খাদ্য ক্রয়ের জন্য এক কোটি ৫০ লাখ, গো খাদ্য ক্রয়ের জন্য এক কোটি ৫০ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে।
তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রীর দিক নির্দেশনায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় গত কয়েকদিন ধরে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। এর ফলে বড় ধরনের কনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অশেষ দয়ায় আমরা সফলভাবে ঘূর্ণিঝড় রিমাল মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছি।
প্রতিমন্ত্রী জানান, রোববার (২৬ মে) সন্ধ্যা থেকে ঘূর্ণিঝড় রিমাল বাংলাদেশের উপকূলবর্তী এলাকায় আঘাত হানে যার প্রভাব দেশের বিস্তৃর্ণ এলাকায় আজও অব্যাহত রয়েছে। রিমালের কারণে উপকূলীয় এলাকাসমূহে পানি ঢুকে মানুষের স্বাভাবিক জনজীবনকে ব্যাহত করেছে। বেশ কিছু ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশব্যাপী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় অনেক জায়গায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। আমরা সরকারের সব বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় রেখে দুর্যোগপূর্ব কার্যক্রম পরিচালনা করেছি এখন দুর্যোগ পরবর্তী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছি।
তিনি জানান, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে পূর্বাভাস দিয়েছে এবং আগাম কার্যাবলী (এন্টিসিপেটরি একশন) ও সাড়াপ্রদানে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করেছে। আমরা আঞ্চলিক বিশেষায়িত আবহাওয়া কেন্দ্রের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছি। এর পাশাপাশি বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য আন্তর্জাতিক পূর্বাভাস মডেল নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সময়োপযোগী কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। এ ঘূর্ণিঝড়টি মোকাবিলায় সার্বক্ষণিক তথ্য বিনিময়ের লক্ষ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের এনডিআরসিসি ২৪ ঘণ্টা খোলা রয়েছে। সকাল থেকেই আমারা ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির তথ্য সংগ্রহ করে যাচ্ছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে উপকূলীয় জেলাসমূহের সংসদ সদস্যদের সঙ্গে ফোন কলে কথা বলে স্থানীয় মানুষের খোঁজ-খবর নিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সার্বক্ষণিক তদারকি করছেন।
দুর্যোগ মোকাবিলা একটি সমন্বিত কার্যক্রম জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী জানান, প্রধানমন্ত্রীর সানুগ্রহ দিক নির্দেশনা, এ কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী সব সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন, বিভিন্ন স্তরের জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতারা, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, সিপিপিসহ অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, আর্মড ফোর্সেস ডিভিশন এবং ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াসহ সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতায় আমরা এ দুর্যোগ কার্যক্রম মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছি বলে আমি মনে করি।ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে ভারি বৃষ্টির কবলে পড়েছে কুমিল্লার অধিকাংশ উপজেলা । বৃষ্টির পাশাপাশি দমকা হাওয়া বয়ে চলেছে।
সোমবার (২৭ মে) ভোর থেকে শুরু হওয়া গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারি বৃষ্টিতে রূপ নিয়েছে, সঙ্গে বেড়েছে বাতাসের তীব্রতা। সরেজমিনে দেখা গেছে, ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে বৃষ্টির কবলে পড়লেও বাতাসের তীব্রতায় এখনো কোনো ক্ষয়ক্ষতির তথ্য পাওয়া যায়নি।
টানা বৃষ্টির কারণে জনজীবনে নেমে এসেছে স্থবিরতা। খুব বেশি প্রয়োজন ঘরের বাইরে খুব একটা বের হচ্ছেন না কেউ। বৈরী আবহাওয়ার কারণে ব্যাহত হয়েছে স্বাভাবিক জীবনযাপন। বিশেষ করে দুর্ভোগে পড়েছেন শ্রমজীবী মানুষরা। দমকা হাওয়ার গতিবেগে উপজেলাবাসী শঙ্কিত হলেও কোনো ক্ষয়ক্ষতির তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি।
লাকসাম উপজেলার বাসিন্দা মানবাধিকার নেতা কাজী মাসউদ বলেন, কয়েকদিন ধরেই শুনছি ঘূর্ণিঝড় আসছে। এরকম খবরে আমরা আতঙ্কিত ছিলাম। ভোর থেকে প্রথমে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়, পরে ধীরে ধীরে বৃষ্টি বাড়তে শুরু করে, সঙ্গে শুরু হয় দমকা বাতাস। টানা বৃষ্টি ও দমকা বাতাসের কারণে জনজীবনে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
ব্রাহ্মনপাড়া প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে আমাদের এখানে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির সঙ্গে বইছে তীব্র বাতাস। এতে জনমনে শঙ্কাসহ জনজীবনে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। তবে এখনো পর্যন্ত আমাদের এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের কারণে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
স্থানীয় বরুড়া আগানগর ডিগ্রি কলেজ এর সহকারী অধ্যাপক আবুল হোসেন বলেন, এমনিতেও এই উপজেলায় বৃষ্টির চাহিদা ছিল। তবে ঘূর্ণিঝড়ের খবরে জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছিল। আজকে ভোর থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়। পরে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখা দেয় ভারি বৃষ্টি ও দমকা বাতাস। তবে এখনো এ উপজেলায় ঘূর্ণিঝড়ে কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি।
ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় কুমিল্লায় ৫৮৭ টি আশ্রয়ন কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে যেখানে ২ লাখ ৯ হাজার ৩৮৫ জনকে আশ্রয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। । এইছাড়া ৪৮০ মেট্রিক টন জি আর চাল মজুদ রাখা আছে। পর্যাপ্ত টিন ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট মজুদ রাখা হয়েছে।
এই বিষয়ে কুমিল্লা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সার্বিক পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মোকাবেলায় কুমিল্লা সিভিল সার্জনের পক্ষ থেকে ২১১ টি মেডিকেল প্রস্তুত রাখা হয়েছে। তার পাশাপাশি ঝড়ের সময় মহাসড়কসহ অন্যান্য জায়গায় যদি গাছ বা ডালপালা ভেঙ্গে রাস্তায় পড়ে থাকে তার জন্য ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল প্রশাসন ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। বিদ্যুৎ বিভাগও দুর্যোগ মোকাবেলায় নানান প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। বিশেষ করে কুমিল্লা দাউদকান্দি হোমনা মেঘনা এই তিনটি উপজেলাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেশি হতে পারে বলে ধারণা করে এই তিন উপজেলার দিকে নজরধারী রয়েছে। ।