অতিথি আপ্যায়ন কিংবা ছোট-বড় অনুষ্ঠান আয়োজন- সবকিছুতেই মাতৃভাণ্ডারের রসমালাই থাকে সব সময়। আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে বেড়াতে গেলে এ অঞ্চলের মানুষ রসমালাইকে বেশি গুরুত্ব দেন।রসমালাই। জিভে জল আনা সুস্বাদু, আর আদি ও খাঁটি রসমালাই মানেই কুমিল্লার রসমালাই। দেশের মানুষের কাছে এ পরিচয় নতুন কিছু নয়। তবে পরিচয়টিকে বিশ্বজুড়ে ‘বাংলাদেশের নিজস্ব’ করে নিতে কুমিল্লার মাতৃভাণ্ডারের রসমালাই ইতোমধ্যে অর্জন করে নিয়েছে জিআই বা ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের স্বীকৃতি। এ স্বীকৃতি কুমিল্লার ঐতিহ্যের মুকুটে যোগ করেছে এক নতুন পালক। শতবর্ষের ঐতিহ্যস্নিগ্ধ রসমালাইয়ের আবেদন কুমিল্লা ও এর আশেপাশের অঞ্চলের মানুষের মনে এরই মধ্যে ঠাঁই করে নিয়েছে আলাদাভাবে। পাশাপাশি থাকে অন্যান্য মিষ্টির সমাহারও। তবে কুমিল্লার মাতৃভাণ্ডারের রসমালাইয়ের কদরই আলাদা।
কুমিল্লা নগরীর মনোহরপুর এলাকায় অবিস্থত মাতৃভাণ্ডার। এখানেই একটি ভিটিপাকা টিনশেড ঘরে তৈরি ও বিক্রি হয় রসমালাই। মাতৃভাণ্ডারের দুই পাশে দুটি এবং উল্টো পাশে আছে আরও একটি মিষ্টির দোকান। কুমিল্লার কান্দিরপাড় থেকে রাজগঞ্জ সড়কের ডান পাশে মনোহরপুরে পাশাপাশি অবস্থানে আছে তিনটি মিষ্টির দোকান। প্রথমে ভগবতী পেড়া ভাণ্ডার, মাতৃভাণ্ডার এবং শীতল ভাণ্ডার। সারা দিনই ক্রেতাদের ভিড় লেগে থাকে মাতৃভাণ্ডারের দরজায়। কুমিল্লানগরী ছাড়াও বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এমনকি অন্যান্য জেলা থেকেও ক্রেতারা এসে এখানকার রসমালাই কিনে নিয়ে যান ৫ কেজি বিশেষ ক্ষেত্রে ১০ কেজি করে। জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার পর এ ভিড় আরও বেড়েছে। ক্রেতাদের ভিড়ে হিমশিম খেতে হয় কর্মচারীদের। নিত্যদিন হাসিমুখেই ভিড় সামাল দেন তারা।
মাতৃভাণ্ডারে প্রতি কেজি রসমালাই বিক্রি হয় ৩৫০ টাকা দরে। এ ছাড়াও এখানে পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি ৩০০ টাকা কেজি, মালাইকারি ৩২০ টাকা কেজি, ক্ষীর ৫৪০ টাকা কেজি, ছানা মুড়কি ৮০০ টাকা কেজি, স্পেশাল পেড়া ৬০০ টাকা কেজি এবং দধি ২২০ টাকা কেজি। তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে ক্রেতাদের কাছে চাহিদার শীর্ষে রয়েছে মাতৃভাণ্ডারের রসমালাই।
পটুয়াখালী থেকে কুমিল্লায় ঘুরতে এসেছেন ৪১তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগের সুপারিশ পাওয়া নাঈম পাহলোয়ান তূর্য। এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে মাতৃভাণ্ডারের রসমালাই কিনতে এসেছেন। তূর্য বলেন, ‘অনেক আগে থেকেই শুনেছি কুমিল্লার রসমালাই খুব বিখ্যাত। আজকে সুযোগ পেলাম একেবারে মাতৃভাণ্ডার থেকে সরাসরি ঐতিহ্যবাহী রসমালাই কিনে নেওয়ার। কুমিল্লায় যেহেতু এসেছি, তাই এখানকার অরিজিনাল রসমালাই না খেয়ে যাচ্ছি না। আমার বন্ধুর কাছে এটাই আবদার ছিল এবং শেষ পর্যন্ত এখানে এলাম। আশা করছি, তৃপ্তি নিয়েই খাব।’
ঢাকা থেকে ব্যক্তিগত কাজে কুমিল্লায় আসা কবির হোসেন বলেন, ‘এর আগে বিভিন্ন জনের মাধ্যমে কুমিল্লা থেকে মাতৃভাণ্ডারের রসমালাই নিয়ে খেয়েছিলাম। আজকে যেহেতু কুমিল্লায় এসেছি, তাই ভাবলাম নিজেই কিনে নিয়ে যাই। রসমালাই বিভিন্ন জায়গা থেকেই কিনে খাওয়া হয়। কিন্তু কুমিল্লার রসমালাইয়ের মতো স্বাদ আর কোথাও পাই না। এটার স্বাদ ও তৃপ্তিই আলাদা।’
কুমিল্লা শহরের বাসিন্দা সালমা খাতুন বলেন, ‘কয়েক দিন পর পরই আমি এখান থেকে রসমালাই নিয়ে যাই। আমার শহরের এমন স্বাদের ও ঐতিহ্যের রসমালাই না খেয়ে থাকতে পারি না।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কুমিল্লায় রসমালাইয়ের আদি উদ্ভাবক ত্রিপুরা রাজ্যের ঘোষ সম্প্রদায়। উনিশ শতকের প্রথম দিকে ত্রিপুরা থেকে ঘোষ সম্প্রদায়ের লোক বিভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে চাহিদা অনুযায়ী এ অঞ্চলের লোকদের বাহারি রকম ও স্বাদের মিষ্টি সরবরাহ করতেন। দুধ জ্বাল দিয়ে ক্ষীর বানিয়ে তার মধ্যে শুকনো রসগোল্লা ডুবিয়ে তৈরি করা হয় ক্ষীরসহ রসগোল্লা। এর নাম দেওয়া হয় ‘ক্ষীরভোগ’। ১৯৩০ সালের দিকে এই রসগোল্লার আকার ছোট করে দুধের ক্ষীরের মধ্যে ডুবিয়ে পরিবেশন শুরু হয় এবং একপর্যায়ে এর নামকরণ করা হয় রসমালাই। ওই সময় থেকেই কুমিল্লার মিষ্টি ব্যবসায়ী ক্ষণীন্দ্র সেন রসমালাই বানিয়ে পরিচিতি পেতে থাকেন।
পরবর্তী সময়ে তার সন্তান শংকর সেনগুপ্তের হাত ধরে এটি কুমিল্লায় ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়। রসমালাইয়ের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে দেশ থেকে বিদেশে। শংকর সেনগুপ্তের মৃত্যুর পর বর্তমানে মাতৃভাণ্ডারের রসমালাইয়ের ব্যবসা পরিচালনা করছেন তার ছেলে অনির্বাণ সেনগুপ্ত। তার হাত ধরেই এসেছে রসমালাইয়ের জিআই পণ্যের স্বীকৃতি।
মাতৃভাণ্ডারের ম্যানেজার তপন দে বলেন, ‘আমাদের ঐতিহ্যবাহী রসমালাই জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, এটা আমাদের জন্য গর্বের। এ স্বীকৃতির পর আমাদের দায়িত্ব আরও বেড়ে গেছে। দূর-দূরান্ত থেকে কাস্টমার এসে রসমালাই কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। অনেকে দেশের বাইরেও নিয়ে যাচ্ছেন। এটা আমাদের জন্য আনন্দের ও গর্বের। আমরা রসমালাইয়ের গুণগতমান ও স্বাদ ঠিক রেখে ক্রেতাদের চাহিদা পূরণ করে যাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে ডুপ্লিকেট কিছু নেই। খাঁটি দুধ সংগ্রহ করে যে পরিমাণ রসমালাই তৈরি করা সম্ভব হয়, আমরা ততটুকুই বানাই। চাহিদা অনেক আছে, কিন্তু পর্যাপ্ত দুধের জোগানের অভাবে আমরা সেই চাহিদা পুরোপুরি পূরণ করতে পারছি না। ইদানীং নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে গ্যাসসংকট। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত গ্যাসের চাপ থাকে না। গ্যাসসংকটের কারণেও উৎপাদন কমেছে।
কীভাবে বানানো হয় রসমালাইকুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী মাতৃভাণ্ডারের রসমালাই কীভাবে বানানো হয়, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল কারিগর সুশীল চন্দ্র দাসের কাছে। মাতৃভাণ্ডারে দীর্ঘ ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে রসমালাই তৈরির কারিগর হিসেবে কাজ করছেন তিনি।
সুশীল চন্দ্র বলেন, ‘এখানে বিভিন্ন গ্রাম থেকে দেশি গরুর খাঁটি দুধ আসে। গোয়ালার কাছ থেকে প্রথমে দুধ সংগ্রহ করা হয়। এরপর ওই দুধ চুলার মধ্যে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় জ্বাল দেওয়া হয়। এক মণ দুধের সঙ্গে ১ কেজি পরিমাণ চিনি মেশানো হয়। এরপর দুই-আড়াই ঘণ্টা জ্বাল দেওয়ার পর দুধ ঘন হয়ে ছানায় রূপ নেয়। এরপর ছানা কেটে ছোট ছোট দানাদার মিষ্টির মতো বানানো হয়। রসের মধ্যে দিয়ে সেটিকে রসমালাইতে পরিণত করা হয়। দুধের ঘনত্ব যত বেশি হয়, রসমালাই তত বেশি সুস্বাদু হয়ে থাকে।’
তিনি বলেন, ‘প্রাপ্ত দুধের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে কী পরিমাণ রসমালাই তৈরি করা যাবে। এক মণ দুধ দিয়ে ১০-১২ কেজি রসমালাই তৈরি করা যায়। দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষজন এসে আমাদের তৈরি রসমালাই কিনে নিয়ে যান, খেয়ে প্রশংসা করেন, শুনতে বেশ ভালোই লাগে।’