কুমিল্লা ব্যুরো:
ভোটের দিন যত ঘনিয়ে আসছে নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণায় বাড়ছে উত্তাপ-উত্তেজনা। সহিংস হয়ে উঠছে ঐতিহ্য ও শিক্ষার নগরী কুমিল্লার রাজপথ। প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থক ও অনুসারীদের অসহিষ্ণুতায় হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি বাড়ছে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ দায়েরের ঘটনা। বিশেষ করে, আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী বনাম দলটির স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে প্রতিদিনই সংঘর্ষ হচ্ছে। এ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কা এড়াতে বাড়তি নিরাপত্তার দাবি জানিয়েছেন বিশিষ্টজনরা।
বিএনপিবিহীন নির্বাচনকে উৎসমুখর, অংশগ্রহণমূলক করার জন্য দলীয় নেতাকর্মীদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। দলের এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কুমিল্লার ১১ আসনের মধ্যে ৮টিতে নৌকা প্রতীকের বিরুদ্ধে ভোটযুদ্ধে নেমেছেন দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। মূলত এসব আসনেই প্রতীক বরাদ্দের পর প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা শুরুর পর থেকে জেলার একাধিক স্থানে নৌকা ও আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ ও হামলা-মামলার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় উভয়পক্ষের অসংখ্য নেতাকর্মী আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।
গতকাল সোমবার (২৫ ডিসেম্বর) বিকেলে কুমিল্লা-৭ আসনে চান্দিনা উপজেলার মাইজখার ইউনিয়নের গজারিয়া এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতা ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মুনতাকিম আশরাফ টিটুর সমর্থকদের কুপিয়ে ও পিটিয়ে আহত করার অভিযোগ ওঠে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রার্থীর সমর্থকদের বিরুদ্ধে। পরে একটি সংবাদ সম্মেলন করেন এবং ফেসবুক লাইভে এসে টিটু ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, ‘সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরে না আসা পর্যন্ত প্রচার-প্রচারণা বন্ধ থাকবে।’এদিকে আসনটির নৌকা প্রার্থী ডা: প্রান গোপাল দত্ত আজ ২৬ ডিসেম্বর স্থানীয় আ. লীগ অফিসে একটি সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীর জনসমর্থন না থাকায় প্রচারণা বন্ধ করে নির্বাচনথোে সরে দাঁড়ানের পায়তারা করছে এখন।
সেখানে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী টিটুর সমর্থকরা দুই ইউনিয়নের ২ টি অফিস পুড়িয়েছি বলে তিনি সাংবাদিকদের অভিযোগ করেন।চান্দিনায় স্বতন্ত্র প্রার্থী টিটু নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা করছে বলেও তিনি সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন।
কুমিল্লা-৬ (সদর) আসনেও আছে নির্বাচনি উত্তাপ। ইতোমধ্যে আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে এই আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনকে পরপর তিনটি শোকজ দিয়েছে অনুসন্ধান কমিটি। এসব শোকজ ও তার বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের তদন্ত নিয়ে আলোচনা ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে।
এই আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য আঞ্জুম সুলতানা সীমাকে নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটির শোকজের চিঠি পেয়েছেন।
কুমিল্লা-৫ আসনে ‘ফুল কপি’ প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী সাজ্জাদ হোসেন বিভিন্ন সংবাদ মাধমে বারবার কালো টাকার ছড়াছড়ির অভিযোগ করছেন। ‘কেটলি’ প্রতীকের আবু জাহেরের অভিযোগ, তার এলাকায় কেউ কেউ পেশিশক্তি ব্যবহারের চেষ্টা করছেন। কোনো ধরনের সংঘাত- মারামারির ঘটনা না থাকলেও আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযান ও শোকজ কুমিল্লা-৫ আসনের মাঠ উত্তাপ ছড়াচ্ছে।
কুমিল্লা-৪ আসনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী রাজী মো. ফখরুলের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে শুরু থেকেই আলোচনার জন্ম দিয়েছেন দেবিদ্বার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে আসা আবুল কালাম আজাদ। এরই মধ্যে এই দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও হাতাহাতির ঘটনায় আহত হওয়ার খবর রয়েছে। আবুল কালাম আজাদ ‘ঈগল’ প্রতীকে নির্বাচন করছেন।
কুমিল্লা-৩ আসনে আদালতের রায়ে প্রার্থিতা ফিরে পেয়ে নির্বাচনি প্রচারণার মাঠ গরম করে তুলেছেন জাহাঙ্গীর আলম সরকার। তিনি ঈগল প্রতীকের প্রার্থী। আওয়ামী লীগের প্রার্থী ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন প্রচার-প্রচারণায় শুরুর কয়েকটি দিন স্বস্তিতে থাকলেও এখন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন জাহাঙ্গীর আলম। সেখানকার নেতাকর্মীরাও দুই নেতার পক্ষে উজ্জীবিত সময় পাড় করছেন।
কুমিল্লা-১১ আসনে ‘ফুলকপি’ প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী মিজানুর রহমান মিজান। কয়েকবার সংবাদ সম্মেলন করে তিনি অভিযোগ করছেন, তার নির্বাচনি প্রচারে বাধা দিচ্ছেন নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর সমর্থকরা।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন কুমিল্লা জেলা সভাপতি আলমগীর হোসেন বলেন , নির্বাচনের যে পরিবেশ এবং পরিস্থিতি তাতে যতই অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষতার কথা বলা হোক না কেন বাস্তবে তা সম্ভব নয়। সরকারি দলের প্রার্থীর সঙ্গে নিজ দলের পদ-পদবিতে থাকা নেতাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে সংঘাত-সহিংসতা অনিবার্য হয়ে উঠেছে। নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘন হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচন কমিশন শুধু শোকজে সীমাবদ্ধ থাকছে। কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এমনিতেই গত কয়েক বছর ধরে সাধারণ মানুষ নির্বাচন বিমুখ। সংঘাত-সহিংসতার কারণে ভোটারদের মনে আতঙ্ক বাড়ছে। যা ভোটারদের নির্বাচন বিমুখিতা বাড়বে। কুমিল্লা জেলায় এখন পর্যন্ত ১১টি আসনে ৪৫টি ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে আড়াই লাখ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। যাদেরকেই নির্বাচন অনুসন্ধান কমিটি শোকজ করেছেন তাদের বেশির ভাগই হেভিওয়েট প্রার্থী।
কুমিল্লার রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক খন্দকার মু. মুশফিকুর রহমান বলেন, আচরণবিধি নিয়ে আরো কঠোর হবে প্রশাসন। পরিবেশ সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক রাখতে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে কাজ করবো আমরা।
দিলীপ মজুমদার
কুমিল্লা ব্যুরোচীফ