বিবর্তন রিপোর্টঃ কুমিল্লার মেঘনায় ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের শটগানের গুলিতে দুচোখ হারিয়ে একেবারেই মানবেতর জীবন-যাপন করছেন জয় মিয়া। মাথার ভেতর এখনো পাঁচটি গুলি রয়েছে তাঁর। মাঝে মাঝেই স্মৃতিভ্রম ও অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়েন।
জয় মিয়া উপজেলার মানিকারচর ইউনিয়নের আমিরাবাদ গ্রামের আসাদ মিয়ার ছেলে। এ ঘটনায় জয় মিয়ার ভাই ছায়েদ মিয়ার দায়ের (মেঘনা থানার মামলা নং০১, তারিখ ৩/১২/২১) করা মামলা তদন্ত শেষে আদালতে অভিযোগ পত্র (চার্জশীট) দাখিল করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআই। কিন্তু আসামিরা এলাকায় প্রকাশ্যে প্রভাববিস্তার সহ ঘুরে বেড়াচ্ছেন। শটগান নিয়ে গুলি ও অন্যতম হামলাকারী সোহাগ আহমেদ বিদেশ যাওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ফেলেছেন। তিন বছর ধরে বিচার না পেয়ে ভুক্তভোগী পরিবার সহ এলাকাবাসীর মনে ক্ষোভ ও হতাশা তৈরি হয়েছে।
জানা যায়, ২০২১ সালের ১১ নভেম্বর মেঘনা উপজেলার মানিকচর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেদিন নির্বাচনী সহিংসতায় দুজন মারা যান। তার মধ্যে মানিকচর ইউনিয়নের বল্লবেরকান্দি গ্রামের মোবারক হোসেনের ছেলে শাওন আহেম্মদ মারা যান। অপরদিকে একই ইউনিয়নের আমারিবাদ গ্রামে শটগানের গুলিতে গুরতর আহত ও দুচোখ হারান জয় মিয়া। তারা দুজনেই আনারস প্রতীকের পরাজিত চেয়ারম্যান প্রার্থী হারুনুর রশীদের অনুসারী ছিলেন।
অভিযুক্ত মোঃ জাকির হোসেন বর্তমান ইউনিয়ন চেয়ারম্যান। তিনি উজানচর গ্রামের জজ মিয়ার ছেলে। ওই নির্বাচনে তিনি নৌকা প্রতীক নিয়ে জয়লাভ করেন। প্রভাব বিস্তার, কেন্দ্র দখল, হামলা-হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে তিনি ক্ষমতা লাভ করেন।
কুমিল্লা পিবিআই এর উপ-পরিদর্শক গোলাম কিবরিয়া দীর্ঘ সময় তদন্ত শেষে জয় মিয়ার উপর ন্যাক্কারজনক হামলায় দায়ের করা মামলায় জাকির হোসেন সহ নয়জনকে দোষী করে কুমিল্লার আমলী আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছেন।
অভিযোগ পত্র থেকে জানা যায়, ঘটনার দিন সকালে মানিকারচর ইউনিয়ন পরিষদের ভোটগ্রহণ চলছিলো। আমিরাবাদ গ্রামের ভোটকেন্দ্রের কাছেই রাস্তা দিয়ে ভোট দিতে যাচ্ছিলেন জয় মিয়া সহ আরো কয়েকজন আনারস প্রতীকের প্রার্থী হারুনুর রশীদের সমর্থকেরা। এমন সময় ওই রাস্তা দিয়ে চেয়ারম্যান প্রার্থী জাকির হোসেন, জসিম উদ্দিন, সোহাগ আহমেদ, গোলাম কিবরিয়া টিপু, জালাল মিয়া, মনির হোসেন ওরফে বাদশা, আসাদ মিয়া, হালিম মিয়া ও আলগমীর হোসেন মোমেন তাদেরকে দেখেই অতর্কিত হামলা চালায় জয় মিয়া সহ অন্যান্যদের উপর। জাকির হোসেনের নির্দেশে সোহাগ আহমেদ শটগান দিয়ে গুলি চালালে মাথায় ও চোখে গুলি লেগে গুরতর আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন জয় মিয়া। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ, পরবর্তীতে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে ভর্তি তরা হয় সেখানে তাঁর ডান চোখ অন্ধ এবং বাম চোখও অন্ধ হওয়ার পথে ছিলো। পরবর্তীতে ভিকটিম জয় মিয়া জমি বিক্রি করে ভারতে গিয়ে চোখের চিকিৎসা করেন। অপারেশন শেষেও তাঁর চোখ গুলো বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
এখন তিনি অন্ধ, চলতে হয় অন্যের সাহায্যে। দেশে এবং ভারতে চিকিৎসা করাতে গিয়ে প্রায় ৭০ লাখ টাকা খরচ করেছেন। তাঁর মাথা থেকে পাঁচটি বুলেট বের করা সম্ভব হয়নি। সেগুলোর যন্ত্রণা ও অন্ধত্ব নিয়ে বেঁচে আছেন। একেকটা দিন কাটে অত্যন্ত দুঃখ কষ্টে। এখনো হামলার বিচার না পেয়ে ডুকরে কেঁদে উঠেন। হামলাকারীদের বিচার নিজ চোখে দেখার সুযোগ না থাকলেও কানে শোনে মরতে চান তিনি।এ বিষয়ে মামলার বাদি জয় মিয়ার ভাই ছায়েদ মিয়া বলেন, চেয়ারম্যান ও তাঁর লোকজন আমাদেরকে প্রতিনিয়ত হুমকি ধমকি দিচ্ছেন। আমরা জীবনের নিরাপত্তা চাই, ন্যায় বিচার চাই।
মুঠোফোনে কথা হয় জয় মিয়ার সাথে, কান্না করতে করতে বলেন আমিতো রাজনীতি করিনা, দল করিনা। আনারস প্রতীকের প্রার্থীর জন্য কাজ করেছি বলে আমার উপর হামলা করেছে। হামলার আগে হুমকি ধমকি দিয়েছিল। সেদিন (ভোটের দিন) কোন কিছু বুঝার আগেই গুলি শুরু করে দেয়। দা ছেনি দিয়ে কুপিয়ে জখম করে রাস্তায় ফেলে চলে যায়। আজ তিনটা বছর আমি চোখে দেখিনা। চিকিৎসা করতে গিয়ে আমি নি:স্ব হয়ে গেছি। মাথায় পাঁচটি বুলেট এখনো রয়ে গেছে। সেগুলোর যন্ত্রণা আর বিচার না পাওয়ার আক্ষেপ নিয়ে দিনগুলি পার করছি। আমি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আদালতের কাছে বিচার চাই। বিচার চোখে না দেখতে পারলেও কানে শোনে অন্তত মরতে চাই।
কুমিল্লা পিবিআই এর উপ-পরিদর্শক গোলাম কিবরিয়া জানান, এ মামলায় অভিযুক্ত চেয়ারম্যান জাকির হোসেন সহ অন্যান্যরা আদালতে আত্মসমর্থন করলে আদালত না মঞ্জুর করে কারাগাড়ে প্রেরণ করেন। পরে জামিনে তারা বের হন। আমি মামলাটি তদন্ত করে আদালতে চার্জশীট দাখিল করেছি। বিচার নিশ্চিতের বিষয়টি এখন আদালতের।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে অভিযুক্ত চেয়ারম্যান জাকির হোসেনের মুঠোফোনে (০১৮১৩৭৭৬০৪১) কয়েকবার কলদিলেও তিনি রিসিভ না করায় বক্তব্য নেয়াসম্ভব হয়নি।