সৌরভ লোধ ||
এক সময় চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার নিজমেহার গ্রামের পালপাড়া এবং রায়শ্রী দক্ষিণ ইউনিয়নের প্রসন্নপুর পালপাড়া ছিল মৃৎশিল্পের জীবন্ত নিদর্শন। সেইসব গ্রাম যেন ছিল মাটির গন্ধে ভরা এক শিল্পের গ্রাম। ঘরের কোণে কোণে মাটির কলস, হাঁড়ি-পাতিল, প্রদীপ আর খেলনার সমাহার—বাংলার লোকজ সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি।
কিন্তু সময়ের স্রোতে আজ সেই শিল্পের আলো নিভু নিভু। আধুনিকতার দৌড়ে যখন প্লাস্টিক, মেলামাইন, স্টিলের পণ্য সহজলভ্য হয়ে উঠেছে, তখন মাটির সেই সৌন্দর্য যেন ব্যয়বহুল বিলাসিতায় পরিণত হয়েছে।
তবুও হার মানেননি কিছু সংগ্রামী শিল্পী। এখনও তারা বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এই প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রহরী হয়ে। নিজমেহার গ্রামের মনি রানী পাল (৪৬), সুভাষ পাল (৬৬), কুমেশ্বর পাল (৬৮)—তারা শুধু মাটির হাঁড়ি-পাতিল তৈরি করছেন না, বহন করছেন একটি সংস্কৃতির উত্তরাধিকার।
এক সময় এই পাড়ার প্রায় ৩০০টি পরিবার মাটির সামগ্রী তৈরি ও বিক্রয়ের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। এখন সংখ্যাটি কমে দাঁড়িয়েছে ১৫-২০টি পরিবারে। দুলাল পাল, নেপালী রানী পাল, মঞ্জু রানী পাল, সেফালী পালরা এখনও প্রতিকূলতার মধ্যেও পূর্বপুরুষের পেশা ধরে রেখেছেন।
সুভাষ পাল বললেন,জন্ম থেকেই শরীরে মাটির গন্ধ লেগে আছে। ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে কাজ শিখেছি, কাঁধে করে মাটির হাঁড়ি-বাটি নিয়ে বিক্রি করেছি ধান, চাল বা টাকায়।কিন্তু আজ আর তিনি মৃৎপণ্য তৈরি করেন না। কুমিল্লার বিজয়পুর বা হাজীগঞ্জ বাজার থেকে পণ্য এনে বিক্রি করেন। তার ছেলে সঞ্জয় পাল থাকেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে।
অন্যদিকে কুমেশ্বর পাল জানান, বরিশাল থেকে সামগ্রী এনে হাটে বিক্রি করি। হাটের দিনে ১২শ’ থেকে ১৫শ’ টাকা আয় হলেও, অন্য দিনগুলোতে দু-চারশ’ টাকাও রোজগার হয় না।
সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের কথা বললেন মনি রানী পাল। এঁটেল মাটির অভাব, দাম বেড়ে যাওয়া, আর্থিক সংকট—সব মিলিয়ে আগের মতো কাজ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।তবুও তিনি এখনো নিজ হাতে মাটির সামগ্রী বানান, আগুনে পোড়ান, বিক্রির জন্য প্রস্তুত করেন।
উচ্চশিক্ষিত যুবক গণেশ পাল জানালেন,খরচ বেড়ে যাওয়ায় আগ্রহ হারাচ্ছে নতুন প্রজন্ম। আগে ৩০০ পরিবারের মধ্যে যারা কাজ করতো, এখন মাত্র ১৫-২০টি পরিবার টিকে আছে।
স্থানীয়রা জানান,এই ঐতিহ্য বাঁচাতে হলে প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, প্রশিক্ষণ, প্রদর্শনী, বাজারজাতকরণসহ নানা উদ্যোগ নিতে হবে।আজ মানুষ প্লাস্টিক, মেলামাইনের দিকে ঝুঁকছে। এই শিল্পকে বাঁচাতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পদক্ষেপ জরুরি।
মৃৎশিল্প শুধু একটি পেশা নয়। এটি বাংলার আত্মা, ইতিহাস, সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। যতদিন পালপাড়ার পরিবারগুলো টিকে থাকবে, ততদিন শাহরাস্তির মাটিতে মৃৎশিল্পের আলো জ্বলবে। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়—এই আলো জ্বালিয়ে রাখার দায়িত্ব কি কেবল তাদেরই? রাষ্ট্র কি তবে শুধু দর্শক হয়ে থাকবে?
