ছবি: ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকা
বিবর্তন ডেক্স:
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবন্তীকা শুক্রবার (১৫ মার্চ) রাত ১০টার দিকে আত্মহত্যা করেছেন। মারা যাওয়ার আগে ফেসবুকে দেওয়া দীর্ঘ স্ট্যাটাসে এক সহপাঠী ও শিক্ষককে দায়ী করে গেছেন। সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম ও সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকীকে দায়ী করে আত্মহত্যা করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবন্তীকা।গতকাল সহপাঠী আম্মানসিদ্দীকি এবং সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকে আটক করেছে বলে জানা গেছে।
এদিকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে অবন্তীকার মরদেহের ময়নাতদন্তের পর তার মরদেহ পুলিশ দুপুর ২টায় তার ছোট ভাই অপূর্ব কাছে হস্তান্তর করে। তারপর সেখান থেকে কুমিল্লার বাগিচাগাঁওয়ে নিজ বাড়িতে মরদেহ আনা হয়। আনুষ্ঠানিকতা শেষে বিকাল ৩টায় নগরীর পুলিশ লাইন উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে নিহতের প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে শাসনগাছা কবরস্থানের পাশে শাসনগাছা ফোরকানিয়া মাদ্রাসা প্রাঙ্গনে শেষ নামাজে জানাজা পর ১৬ মার্চ বিকেল ৪ টায় বাবার কবরের পাশেই অবন্তীকাকে দাফন করা হয়। কুমিল্লা সরকারি কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মৃত জামাল উদ্দিনের মেয়ে অবন্তীকা। তিনি কুমিল্লা ওয়াই ডব্লিউ সি এ প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করে কুমিল্লা নওয়াব ফয়জুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে মাধ্যমিক পাশ করেন।
অবন্তীকার ছোট ভাই অপূর্ব বলেন,জানাজা নামাজের পূর্বে কাঁদতে কাঁদতে অবন্তিকার ভাই অপূর্ব বলেন,বোনের এধরণের আত্মহত্যা মেনে নিতে পারছি না আমি। বাবামার আদরে ছোটথেকে আমরা এক সাথে বড় হয়েছি, আমার বোন প্রতিবাদী মানসিকতার মানুষ ছিল। সে স্যোসাল এ্যাক্টিভিস্ট ছিল। ভাই -বোন মা বাবা সহ আমাদের চার জনের মধ্যে বাবা চলে গেলেন গত বছর এখন বোন ও হারালাম। তিনি বলেন, যে বা যারা আমার এই শান্ত নিরীহ বোনের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটাকে অতিষ্ঠ করে নিশ্চিত আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিয়েছে। তাদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি চাই আমি। যারা আমার আপুকে টর্চার করে হত্যা করেছে। তাদের বিচার করুন। এভাবে আমার আপুকে তারা টার্চার করলো, কিন্তু শিক্ষক কাছে বিচার চেয়েও ও (অবন্তিকা) বাঁচলো না। এদের সবাইকে ফাঁসি দিতে হবে।এসময় অবান্তিকার স্কুল ও কলেজের শিক্ষক, সহপাঠী, স্বজনরা দোষীদের সর্বোচ্চ সাজা ফাঁসি দাবি করেন।
এদিকে অবান্তিকাকে এক নজর দেখতে কুমিল্লা নগরীসহ বিভিন্ন উপজেলা থেকে হাজার হাজার মানুষ তার দ্বিতীয় জানাজায় এসে উপস্থিত হন। গতকাল থেকে তার মৃত্যুতে শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়েছে তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার লোকজন। আত্মীয়-স্বজনের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে কুমিল্লায় নগরীর বাগিচাগাও এলাকা।
ফাইরোজ অবন্তীকা জবির (২০১৭-১৮ শিক্ষা বর্ষ) মাস্টার্স এর আইন বিভাগের ছাত্রী ছিলেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়ে ফাইরুজ সাদাফ অবন্তীকার লাশের গাড়ি দেখে জ্ঞান হারিয়ে রাস্তায় পড়ে গেছিলেন তার মা তাহমিনা শবনম। শনিবার বেলা ২টার দিকে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে তার লাশ নিজ বাড়িতেআনা হলে ফায়ার সার্ভিস এলাকাজুড়ে কান্নার রোল ওঠে। লাশের গাড়ি দেখেই এগিয়ে আসেন স্বজন ও প্রতিবেশীরা।অবন্তিকার মা তাহমিনা বেগমকে বলতে শোনা যায়, স্রষ্টা সবাইকে নিয়ে যায়। আমাকে কেন নেয় না। মারতে মারতে আল্লাহ আমার স্বামীও নিলো মেয়েও নিলো। এই আমি কার লাশ দেখছি? এটাতো আমার তিল তিল করে গড়ে ওঠা স্বপ্নের লাশ দেখছি বলে হুঁশ হারিয়ে মাটিতে লুড়িয়ে পড়েন। এ সময় আত্মীয়রা তাকে ধরে সড়ক থেকে ওঠায়।কান্নার ফাঁকে মা তাহমিনা শবনম বলে উঠলেন,ঢাকার বাসায় যেখানে তার সংগে একই বাসায় থাকা অন্যান্য মেয়েরা ছিল, অবন্তীকা তখন বাসায় ছিল না, কিছুদিন আগে ওই ইউনিভার্সিটির ছেলেগুলো ওর সেই বাসা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, এবং বলে গেছে যে অবন্তীকার নামে জিডি আছে, ওকে আর্মি থেকে বের করে দিয়েছে। কারণ ওই বাসার মেয়েগুলার তো জানার কথা না। এখন আমার মেয়ে এসে আমাকে বলতেসে মা ওরা তো আমাকে মেন্টাল টর্চার করতেসে, আমি পড়তে পারি না। পরে আমি ওর সাথে গেলাম, গিয়ে আমি যখন গেলাম মেয়েরা তখন চুপ। আমি বুঝতে দেইনাই মেয়েদেরকে যে ওর পরীক্ষা চলতেছে। মেয়ের পরীক্ষা যখন শেষ আমি যেদিন চলে আসি ওইদিন মেয়েরা বলতেছে তোমার কি পরীক্ষা শেষ নাকি শুরু হবে, তার মানে এটা ইউনিভার্সিটি থেকে ইন্ধন দিয়ে রাখছে তাকে কিভাবে টর্চার করবে। আম্মান নামের একটা ছেলে, রাফি, মাহিয়ান, লাকি, মিমি, আঁখি, বন্যা, দিন ইসলাম যিনি মূল যে নাকি মেয়েকে বিভিন্নভাবে ইন্ধন দিয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম যে আপনারা ছেলেদেরকে জিজ্ঞেস করেন ছেলেরা কেন এরকম করছে? , সে তো একটা ভালো র্স্টুডেন্ট, ক্লাসের টপ লিস্টের মেয়ে কেনো এরকম করছে? বলে যে আপনার মেয়ে একটা মেসেজ দিয়েছে, মেসেজটি আমার কাছে আছে, এই মেসেজে কোনোদিন কোনো জিডি হয় না কোনো কিচ্ছু হয় না যেমন ও আমাকে মেরেছে বা ও এখানে আমার সাথে এফেয়ার করেছে এই কথাগুলা দিয়ে তো কখনো জিডি হতে পারে না। পুলিশ দিয়ে আমাকে ফোন দিয়েছে এবং পুলিশ শুনেছি তাদের এলাকার ভাই। পরে আমি মা হিসেবে ডিআইজি ভাই কে ফোন দিয়েছি, উনি আমাকে বলছেন ভাবী আমাকে বলতেন আমি ব্যাবস্থা নিতাম। পরে দেখলাম ইউনিভার্সিটিতে মোটামুটি দফারফা পরে চেয়ারম্যান এর কাছে গেলাম, চেয়ারম্যানকে ১০টা নাম দিয়ে আসছি আমি। চেয়ারম্যান ফোন দিয়েছে আমার সামনে প্রক্টরকে ব্যাবস্থা নেয়ার জন্য তাইলে প্রক্টর কি ব্যাবস্থা নিলো বলেন। আজকে এক বছর ধরে আমি তো হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি আপনার স্যারকে নিয়ে, এইযে মেয়েটাকে এই হয়রানি করলো মেয়েটাকে এখন বলে তোর বাবার কাছে জাস নাই? তোর বাবা হাসপাতালে ছিল তুই প্রোগ্রামে, মানে সর্বদিক দিয়ে মেয়েটাকে মেন্টাল টর্চার। আর দেখলে আহারে বাবা নাই মানসিক সমস্যা হচ্ছে না? আহারে ওর বাবাটা মরে গেল, মানসিক সমস্যা হচ্ছে? তাইলে এর উত্তর আমি কি চাইবো কার কাছে চাইবো।
উল্লেখ্য, শুক্রবার রাত ১০টার দিকে ফেসবুক আইডিতে এক পোস্টে নিজের আত্মহত্যার জন্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম ও সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকীকে দায়ী করেন ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকা।
ফেসবুকে ওই স্ট্যাটাস দেওয়ার পর কুমিল্লার বাগিচাগাঁও ফায়ার সার্ভিস পুকুরপাড়ের নিজ ঘরের ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় তার লাশ পাওয়া যায়। রাত সোয়া ১০টার দিকে তাকে কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। তার মৃত্যুর বিষয়টি বাংলা ট্রিবিউনকে নিশ্চিত করেছেন কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক সার্জন ডা. আব্দুল করিম খন্দকার। তিনি কুমিল্লা সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যাপক প্রয়াত জামাল উদ্দিনের মেয়ে।
মারা যাওয়ার আগে ফেসবুকে দেওয়া অবন্তিকার স্ট্যাটাসটি তুলে ধরা হলো, আমি যদি কখনো সুইসাইড করে মারা যাই তবে আমার মৃত্যুর জন্য একমাত্র দায়ী থাকবে আমার ক্লাসমেট আম্মান সিদ্দিকী, আর তার সহকারী হিসেবে তার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে তাকে সাপোর্টকারী জগন্নাথের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম। আম্মান যে আমাকে অফলাইন ও অনলাইনে থ্রেটের (হুমকি) উপর রাখতো সে বিষয়ে প্রক্টর অফিসে অভিযোগ করেও আমার লাভ হয় নাই। দ্বীন ইসলাম আমাকে নানানভাবে ভয় দেখায়, আমাকে বহিষ্কার করা ওনার জন্য হাতের ময়লার মতো ব্যাপার।আমি জানি এখানে কোনো জাস্টিস (বিচার) পাবো না। কারণ দ্বীন ইসলামের অনেক চামচা ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াবে। এই লোককে আমি চিনতামও না। আম্মান আমাকে সেক্সুয়ালি এবিউজিভ কমেন্ট করায় আমি তার প্রতিবাদ করলে আমাকে দেখে নেওয়ার জন্য দ্বীন ইসলামের শরণাপন্ন করায়। আর দ্বীন ইসলাম আমাকে তখন প্রক্টর অফিসে একা ডেকে নারীজাতীয় গালিগালাজ করে। সেটা অনেক আগের ঘটনা হলেও সে এখনো আমাকে নানাভাবে মানহানি করতেসে বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্ন কথা বলে।
আর এই লোক কুমিল্লার হয়ে কুমিল্লার ছাত্র কল্যাণের তার ছেলেমেয়ের বয়সী স্টুডেন্টদের মাঝে কী পরিমাণ প্যাঁচ ইচ্ছা করে লাগায় সেটা কুমিল্লার কারো সৎ সাহস থাকলে সে স্বীকার করবে। এই লোক আমাকে আম্মানের অভিযোগ এর প্রেক্ষিতে ৭ বার প্রক্টর অফিসে ডাকায় নিয়ে “…. (প্রকাশ অযোগ্য শব্দ) তুই এই ছেলেরে থাপড়াবি বলসস কেনো? তোরে যদি এখন আমার জুতা দিয়ে মারতে মারতে তোর ছাল তুলি তোরে এখন কে বাঁচাবে?
আফসোস এই লোক নাকি ঢাবির খুব প্রমিনেন্ট ছাত্রনেতা ছিল। একবার জেল খেটেও সে এখন জগন্নাথের প্রক্টর। সো ওর পলিটিক্যাল আর নষ্টামির হাত অনেক লম্বা না হলেও এতো কুকীর্তির পরও এভাবে বহাল তবিয়তো থাকে না এমন পোস্টে। কোথায় এই লোকের কাজ ছিল গার্ডিয়ান হওয়া, আর সো কিনা আমার জীবনটারেই শেষ না হওয়া পর্যন্ত মুক্তি দিলো না। আমি উপাচার্য সাদোকা হালিম ম্যামের কাছে এই প্রতিষ্ঠানের অভিভাবক হিসেবে বিচার চাইলাম।
আর আমি ফাঁসি দিয়ে মরতেসি। আমার উপর দিয়ে কী গেলে আমার মতো নিজেকে এতো ভালোবাসে যে মানুষ সে মানুষ এমন কাজ করতে পারে। আমি জানি এটা কোনো সলিউশন না কিন্তু আমাকে বাঁচতে দিতেসে না বিশ্বাস করেন। আমি ফাইটার মানুষ। আমি বাঁচতে চাইছিলাম! আর পোস্ট মর্টেম করে আমার পরিবারকে ঝামেলায় ফেলবেন না। এমনিতেই বাবা এক বছর হয় নাই মারা গেছেন, আমার মা একা। ওনাকে বিব্রত করবেন না। এটা সুইসাইড না এটা মার্ডার। টেকনিক্যালি মার্ডার। আর আম্মান নামক আমার ক্লাসমেট ইভটিজারটা আমাকে এটাই বলছিল যে আমার জীবনের এমন অবস্থা করবে যাতে আমি মরা ছাড়া কোনো গতি না পাই। তাও আমি ফাইট করার চেষ্টা করসি। এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে সহ্য ক্ষমতার।