বিবর্তন রিপোর্ট :
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেছেন, স্বাধীনতাবিরোধীরা সুযোগ পেলেই ছোবল মারতে চায়। কিন্তু এ দেশে স্বাধীনতাবিরোধীরা নির্মূল হবে, তাদের পদচিহ্নও থাকবে না। সেই অপশক্তিকে নিশ্চিহ্ন করতে যে প্রয়াস আমাদের প্রয়োজন, তা-ই করতে হবে।
শনিবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ৮ম জাতীয় সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় রাষ্ট্রপতি এসব কথা বলেন। অপশক্তির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, বিজয়ের অর্ধশতক পেরিয়ে গেলেও রাজপথে আজও শোনা যায় ’৭৫- এর হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার। এই কথা শুনলে কি ঠিক থাকা যায়? স্বাধীনতাবিরোধীরা এখনও আছে বলেই ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রয়োজন রয়েছে। রাষ্ট্রপ্রধান বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া বিশ্বে সমাদৃত হয়েছে। কিন্তু আজকাল বহির্বিশ্বে থেকে যারা বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচার করছে, তারা মূলত এই দেশটার অগ্রগতি থামিয়ে দিতে চায়।
বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে বেড়ে উঠতে পারে সে লক্ষ্যে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার কথাও বলেন রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন। তিনি বলেন, ‘এই লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শক্তির ইস্পাত কঠিন ঐক্যের বিকল্প নেই। ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থকে উপেক্ষা করে দেশ ও জনগণের স্বার্থে সবাইকে কাজ করতে হবে।’ রাষ্ট্রপতি সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুর দর্শন, ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতার বোধকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ারও তাগিদ দেন।
তরুণদের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘ডিজিটাল মাধ্যমকে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করুন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়ুন, বঙ্গবন্ধুর জীবনী ও আদর্শ সম্পর্কে জানুন। মননে, বোধে, জীবনাচরণে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে বুকে লালন করে বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরুন।’
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ২১ বছর পর ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে শুরু হয়ে এই আন্দোলনের প্রাজ্ঞ নেতৃবৃন্দ প্রায় ৩৩ বছর ধরে নানা চড়াই-উতরাই, ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে এই সংগঠনকে আজকের জায়গায় নিয়ে এসেছেন।
রাষ্ট্রপতি বলেন, সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশও ডিজিটাল বিপ্লবের পাশাপাশি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হবে। তিনি ধর্মীয় ও ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করার আহ্বান জানান।
মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী দক্ষিণ এশীয় গণসম্মিলনের সভাপতি আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী সরকারের সহযোগিতা প্রদানের জন্য সংস্থাটি কাজ করছে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি যে দাবি তুলেছিল, আমাদের রাষ্ট্রপতি তার নেতৃত্বে কমিশন গঠন করেছিলেন। নির্মূল কমিটি সে তদন্তে সহযোগিতা করেছিল।
সংগঠনের সভাপতি শাহরিয়ার কবিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানের শুরুতে রাষ্ট্রপতিকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন শহীদ সন্তান শমী কায়সার ও আসিফ মুনীর তন্ময়। উদ্বোধনী অধিবেশনে আরও বক্তব্য রাখেন, মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলিম, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক ড. নিমচন্দ্র ভৌমিক, খ্রিষ্টান এসোসিয়েশনের সভাপতি মানবাধিকার নেতা নির্মল রোজারিও, আদিবাসী মুক্তি মোর্চার সভাপতি অধ্যাপক যোগেন্দ্রনাথ সরেন, বুড্ডিস্ট ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ভিক্ষু সুনন্দপ্রিয়, ন্যায় অধিকার তৃতীয় লিঙ্গ উন্নয়ন সংস্থার চেয়ারম্যান সমাজকর্মী আনোয়ারা ইসলাম রাণী এবং ৮ম জাতীয় সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক কাজী মুকুল।
সম্মেলনে তিনটি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় অধিবেশেন প্রধান অতিথি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক। তিনি বলেন, সরকারকে কোনো কোনো সময় আপস করতে হলেও, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটি সব সময় সক্রিয়। সরকার চেষ্টা করছে। তবে সরকারের বাইরে থেকেও অনেক কিছু করার আছে। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ গড়ার জন্য সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে কাজ করার আহ্বান জানান মন্ত্রী। এই অধিবেশনে আরও বক্তব্য রাখেন ওয়ার্কাস পার্টির সভাপতি হাসানুল হক ইনু, জাসদের সভাপতি রাশেদ খান মেনন, বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন ইউসুফ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ প্রমুখ। অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী।
আলোচনায় হাসানুল হক ইনু বলেন, দেশে এখন মোল্লাতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে। স্বাধীনতার বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে তাদের দাঁড় করিয়েছে। এই মোল্লাতন্ত্রের প্রধান পৃষ্ঠপোষক বিএনপি। মৌলবাদি যত পাখি সব এসে বিএনপির ডালে আশ্রয় নিয়েছে। বাসা বেধেছে। সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন, এই সব পাখিদের খুদ কুড়া দিয়ে কাছে ডেকে লাভ হবে না। মৌলবাদীদের পোষ মানা আওয়ামী পাখি হবে না।
রাশেদ খান মেনন বলেন, গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে লড়াই আমরা শুরু করেছিলাম তা থেকে বহু দুরে চলে গেছি। ক্রমাগত আত্মসমর্পন করছি আমরা। তিনি এ প্রসঙ্গে মৌলবাদীদের হুমকির মুখে পাঠ্যপুস্তক থেকে তৃতীয় লিঙ্গ বিষয়ক রচনা সরিয়ে নেওয়ারও সমালোচনা করেন।
রামেন্দু মজুমদার বলেন, শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা যদি একেবারে পাঠ্যসুচী থেকে শুরু করে ছেলে মেয়েদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা না বলতে পারি তাহলে সামনে এগিয়ে যেতে পারবো না।
গোলাম কুদ্দুছ বলেন, একটা জটিল পরিস্থিতি চলছে এখন। ঐক্যবদ্ধভাবে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারন না করলে রাষ্ট্র অসাম্প্রদায়িক হবে না। এক্ষেত্রে রাজনীতিকে আগে সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত হতে হবে।
নির্মূল কমিটির সম্মেলনে সারাদেশ থেকে প্রায় দুই হাজার প্রতিনিধি ও আমন্ত্রিত অতিথি যোগ দেন। এ উপলক্ষ্যে পুরো প্রাঙ্গণটি বিভিন্ন প্লাকার্ড ফেস্টুন ইত্যাদি দিয়ে সাজানো হয়। প্রথম অধিবেশন শেষে
দুপুরে সচিবালয়ের সামনের রাস্তা থেকে দোয়েল চত্বর হয়ে পুনরায় সম্মেলন কেন্দ্রে এসে শেষ হয় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। সন্ধ্যায় বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় অধিবেশন সম্পন্ন হয়। সংগঠনের কেন্দ্রীয় ও বিভাগীয় নেতাদের রিপোর্ট পেশ করার মাধ্যমে সম্মেলনের তৃতীয় অধিবেশন আরম্ভ হয় সন্ধ্যায়। সমাপনী অধিবেশনে বক্তব্য রাখেন কেন্দ্র ও বিভিন্ন জেলার প্রতিনিধিরা। এরপর অষ্টম জাতীয় সম্মেলনের প্রস্তাব, আগামী ৩ বছরের কর্মসুচি ঘোষণা এবং নতুন কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী ও উপদেষ্টা পরিষদের নাম ঘোষণার মধ্য দিয়ে দিনব্যাপী সম্মেলনের সমাপ্তি ঘটে।