বিবর্তন রিপোর্টঃ
সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া কাটা সহ বিভিন্ন উপায়ে ভারত থেকে কুমিল্লা সিমান্তের কমপক্ষে ৫ টি পয়েন্ট দিয়ে পাচার করে আনা হচ্ছে গরু।
কোরবানি ঈদকে সামনে রেখে দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে গরু বাংলাদেশে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। কুমিল্লা সীমান্তের ১০৬ কিলোমিটার অংশের কমপক্ষে ৫টি পয়েন্ট দিয়ে চোরাকারবারিরা সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে গরু আনছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সীমান্ত এলাকার সচেতন এক কৃষক জানান, সব গরু সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন গ্রামের কৃষকদের দেশি গরুর সঙ্গে মিশিয়ে রাখেন । পরে এই গরু হাটে বিক্রি করছেন। ক্রেতারা গরুগুলো কুমিল্লার উপর দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাচ্ছেন।
এদিকে, ভারত থেকে গরু আনা যাবে না সরকারের এমন ঘোষণায় আশায় বুক বেঁধেছিলেন দেশি খামারিরা। তবে, এখন সীমান্ত দিয়ে গরু প্রবেশ করায় লোকসানের শঙ্কায় রয়েছেন তারা। প্রশাসনের দাবি, ভারত থেকে গবাদি পশুর অনুপ্রবেশ ঠেকানো হচ্ছে। কুমিল্লায় এবার প্রায় ১০ হাজারেরও বেশি পশু কোরবানির জন্য প্রস্তুত আছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তর।
সূত্র জানায়, সীমান্তের কিছু এলাকায় কড়া নজরদারি থাকলেও কয়েকটি স্থান দিয়ে অন্য বছরের চেয়ে বেশি পশু ঢুকছে এবার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে আনা হচ্ছে গরু। আর এ কাজে জড়িত রয়েছেন এলাকার বিভিন্ন পর্যায়ের ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার বিবিরবাজার ও সদর দক্ষিণ উপজেলার গলিয়ারা, ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার আশাবাড়ি, বুড়িচং উপজেলার ভবেরমূড়া, চৌদ্দগ্রাম উপজেলা ডিমাতলী এলাকাকে গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট হিসেবে বেছে নিয়েছে চোরাকারবারিরা। এসব এলাকা দিয়ে প্রতিনিয়ত অবাধে আসছে পশু। এক সূত্র থেকে জানা যায়, কুমিল্লা অঞ্চলে মাহবুব নামে এক ব্যাপারি প্রতিদিন ৩০০-৩৫০টি গরু হাতবদল করেন সীমান্ত এলাকায়। তিনি কক্সবাজারের উখিয়ার একটি সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত। এছাড়া, কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার গলিয়ারা ইউনিয়নের অন্তত: আরও চিহ্নিত দুই চোরাকারবারি গলিয়ারা সীমান্ত দিয়ে কোরবানিকে সামনে রেখে গরু আনছেন। অভিযোগ রয়েছে, এদের মত জেলাজুড়ে আরো কয়েকজন চোরাকারবারি পশু আনার কাজে সক্রিয় রয়েছেন।
বৃহস্পতিবার (৫ জুন) ব্রাহ্মণপাড়ার আশাবাড়ি সীমান্ত এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, সীমান্তের কাটাতাঁরের নিচ দিয়ে ১০ ফুট থেকে ১২ ফুটের প্রায় ১০টি কালভার্ট রয়েছে। সেখানে বসে ধান শুকাচ্ছিলেন রাবেয়া বেগম ও তপুরা বেগম। প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে তারা বলেন, ‘প্রতিদিনই তো মদ, গাঁজার লগে গরুও আইতেছে। এডি আমগোরে জিগাইয়া কী লাভ। বড়লোকেগো কাম এডা। আমরা কিছু কইলে আমগোরে জিন্দা মাইরালাইবো। বিজিবির লোকেরা সবডিই তো সামনে থায়, কই কেউ তো তাগোরে কিছু কয় না। ভাই আমরা কিছু জানি না’।
একই এলাকার খামারি শফিক মিয়া বলেন, ‘চোখের সামনে দিয়ে রাতের বেলা আমগো এদিক দিয়া গরু নামতেছে। বিজিবিরা এগুলা দেইখাও কিছু কয় না। তারগো হাত শক্তিশালী। তারগোরে কেউ কিছু কইতে পারে না। কোরবানকে সামনে রেখে আমরা যারা গরু পালন করি, এভাবে গরু নামতে থাকলে আমগো বাড়িঘর বেইচা দিতে হবে। সরকার কী এগুলা দেখে না।’
কুমিল্লা নগরীর একটি এগ্রো ফার্মের খামারি ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘আমরা পশু পালন করি। বছরের একটি দিনের (কোরবানির ঈদ) জন্য আমাদের অপেক্ষা থাকে। চোরাইভাবে ভারতীয় গরু এনে আমাদের স্বপ্ন চুরমার করা হচ্ছে। আমরা সরকারে কাছে অনুরোধ করছি, এভাবে ভরতীয় গরু আসতে থাকলে আমরা শেষ হয়ে যাবো।’
লালমাই উপজেলার বেলঘর এলাকার খামারি মোতলেব হোসেন বলেন, ‘কোরবানি ঈদের জন্য প্রতিবছরই গরু পালন করি। কিন্তু , কোনোভারেই ন্যায্য দাম পাই না। কোরবানির হাটের শেষ দিকে ভালো দাম পাওয়ার আশায় থাকি। ভারতীয় গরুর চাপে তখন আর দাম পাওয়া যায় না। গত বছরও লোকসান হয়েছিল। এবার দেখি আল্লাহ কপালে কি রেখেছেন।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কুমিল্লার পুলিশ সুপার আব্দুল মান্নান বলেন, ‘আগামীকাল রোববার আমাদের আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ক সভা রয়েছে। সেখানে আমরা এই বিষয়টি গুরুত্বসহকারে আলোচনা করব। উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে আশা করছি’।
কুমিল্লা ১০ ব্যাটেলিয়ন বিজিবি (সেক্টর কমান্ডার) কর্নেল মোহম্মদ শরিফুল ইসলাম মিরাজ বলেন, ‘কুমিল্লা বিজিবির চার ব্যাটালিয়নের অধীনে সীমান্ত এলাকা রয়েছে ১০৬ কিলোমিটার। দীর্ঘ এ সীমান্তের মানবপাচার ও চামড়াসহ বিভিন্ন পণ্য চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে একাধিক সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। প্রতিনিয়ত অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। দেশি খামারিদের বাঁচাতে ঈদুল আজহায় সামনে রেখে চোরাইপথে যেন পশু আসতে না পারে,তাই সীমান্তে কঠোর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ থেকে একটি গরু ও যেন অবৈধভাবে দেশে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য আলাদা গোয়েন্দা নজরদারির পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে টহল’।