বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা আ ক ম বাহাউদ্দীন বাহার কুমিল্লা-৬ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য এবং কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী এই নেতার মেয়ে তাহসিন বাহার সূচনা এবার কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। তাই বাবা হিসেবে বেশ উৎফুল্ল বাহার শনিবার রাতে ফলাফল হাতে পেয়েই ফোনে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে। এক পর্যায়ে ফুফু’র (প্রধানমন্ত্রী) সাথে কথা বলতে বাবা এম পি বাহার ফোন বাড়িয়ে দেন তার সুযোগ্যা কন্যা কুমিল্লার প্রথম নারী মেয়র তাহসিন বাহার সূচীর হাতে।এসময় ইতিহাস গড়ে মেয়র হওয়া বাহারকন্যা এতটা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন যেন মুখ থেকে কথা বের হচ্ছিল না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার সময় সূচনা বারবার পথচলায় তার দোয়া কামনা করেন। আবদার করেন দ্রুত যেন দেখা করার সুযোগ পান।অপর প্রান্ত থেকে নিরাশ করেননি খোদ প্রধানমন্ত্রীও। ফোনালাপ শুনে আঁচ করা গেছে, সাক্ষাতের জন্য দফতরের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করারও পরামর্শ দেন সরকারপ্রধান।এদিকে নগরবাসী কুমিল্লায় প্রথম নারী মেয়র পেয়ে এর আগে শনিবার (৯ মার্চ) বেসরকারিভাবে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে তাহসিন বাহার সূচীকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। বেসরকারি ফলাফলে তিনি মোট পেয়েছেন ৪৮ হাজার ৮৯০ ভোট। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মনিরুল হক সাক্কু পেয়েছেন ২৬ হাজার ৮৯৭ ভোট। ঘোড়া প্রতীকে মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন পেয়েছেন ১৩ হাজার ১৫৫ ভোট এবং হাতি প্রতীকে নূর উর রহমান মাহমুদ তানিম পেয়েছেন পাঁচ হাজার ১৭৩ ভোট।কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে ভোট প্রদানের হার ৩৮ শতাংশ বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশন।নির্বাচনের বেসরকারি ফলাফল ঘোষণার পর ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা গেছে, চেয়ারে বসে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ফোনে কথা বলছেন এমপি বাহার। পাশে মেয়ে সূচনাসহ আরও কয়েকজন দাঁড়ানো। কথা বলার মাঝে প্রধানমন্ত্রীকে আপা সম্বোধন করে মেয়ের সঙ্গে কথা বলার অনুরোধ করেন এম পি বাহার। পাশে থাকা মেয়েকে বললেন, “তোমার ফুফু’র( প্রধান মন্ত্রী) সাথে কথা বলো”বাবার হাত থেকে ফোন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সালাম বিনিময় শেষে খানিকক্ষন আগের ঘোষণায় বিজয়ী কুমিল্লার নবনির্বাচিত মেয়র বলেন, আমি অপেক্ষায় আছি আপনার (প্রধানমন্ত্রী) সঙ্গে আমার কখন দেখা হবে ? আমি আপনাকে দেখার অপেক্ষায়।এরপর বারবার নতুন পথচলায় প্রধানমন্ত্রীর দোয়া ও পরামর্শ চান বাহারকন্যা। তাঁর আগে ফোনে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বাবা এম পি বাহারকে বলতে শোনা গেছে, “আমার ফুল আপনাকে দেয়া হয়নি, মেয়ের সাথে আমার ফুলও আপনাকে দেয়া হয়ে যাবে”।ডা. তাহসিন বাহার সূচনা কুমিল্লা মিশনারী স্কুল থেকে মাধ্যমিক, কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। ময়নামতি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এমবিবিএস পাস করে মানবতার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেন।সূচনার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন “জাগ্রত মানবিকতার” প্রতিষ্ঠাতা ও সাধারণ সম্পাদক। নিজ উদ্যোগে নিজ অর্থায়নে এই সংগঠন থেকে প্রতি বছর মেডিক্যাল ক্যাম্প, ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প ছাড়াও করোণা বিপর্যয়ে ২০ হাজারের বেশি অসহায় পরিবারকে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার কাজে সহযোগিতা করেছেন। জাগ্রত মানবিকতার প্রতিষ্ঠাতা ও সাধারণ সম্পাদক সূচনা তার বাবার উদ্যোগে নিজের প্রতিষ্ঠান থেকে এই কাজগুলো করেন। এ ছাড়া বড় কয়েকটি কাজ অনেকটা অগোচরেই করে গেছেন।কুমিল্লা সিটির ২৭টি ওয়ার্ডের পাশাপাশি জেলার ১৭টি উপজেলায় জাগ্রত মানবিকতা কাজ করছে নিয়মিত। প্রতিনিয়ত তরুণ-তরুণীরা যুক্ত হচ্ছেন এ প্লাটফর্মে। শহরের আশ্রম, এতিমখানা, মাদরাসায় তাদের সহযোগিতা নিয়মিতই যায়। করোনাকালীন লকডাউনে মানুষ যখন ঘড় থেকে বের হতে পারেননি তখন অসহায়, গরীব, দুখী মানুষের জন্য তাদের ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দিয়েছেন। করোনা আক্রান্ত রোগীদেরকে দিয়েছেন অক্সিজেন সিলিন্ডার। লকডাউনের সময় নগরীর ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য পনেরো দিনের খাবার দিয়েছেন। এছাড়া অক্সিজেন ব্যাংক ও প্লাজমা সহায়তা করেছেন শতাধিক মানুষকে। নারীদের জন্য ফ্রি অ্যাডভোকেসি ও সমাজে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে সেমিনারের মাধ্যমেও সাধারণ মানুষকে উৎসাহিত করেছেন ডা. সূচনা।২০২০ সালে কুমিল্লা জেলার সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখায় মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে জাগ্রত মানবিকতা’র প্রতিষ্ঠাতা ও সাধারণ সম্পাদক তাহসিন বাহার সূচনাকে জয়িতা সম্মাননা-২০২০ প্রদান করা হয়। তাঁর মানবদরদী কাজের জন্য ২০২১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি “সেভ দ্য ফিউচার ফাউন্ডেশন” কর্তৃক তাকে বিশেষ সম্মাননা পদক প্রদান করা হয়।এ ছাড়াও ডা. তাহসিন বাহার সূচনাকে তার কাজের অবদান ও অর্জনের স্বীকৃতি হিসেবে ‘টেন আউটস্ট্যান্ডিং ইয়াং পার্সনস (টিওওয়াইপি) অ্যাওয়ার্ড-২০২১, থাইল্যান্ডের ব্যাংককে গ্লোবাল ইয়ুথ পার্লামেন্ট আয়োজিত গ্লোবাল ইয়ুথ লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড-২০২২ পদক দেওয়া হয়।জাগ্রত মানবিকতা ছাড়াও তিনি বাংলাদেশ জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদের পরিচালনা বোর্ডের সদস্য, বাংলাদেশ জাতীয় অন্ধ কল্যাণ সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবেও তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন।ডা. তাহসিন বাহার সূচনা কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হওয়ায় কুমিল্লা নগরবাসী প্রথম সুশিক্ষিত নারী মেয়র পেলেন। এতে খুশি কুমিল্লার সর্বস্তরের মানুষ।মেয়ের কুমিল্লা নগর বাসীর ভোটে মেয়র হিসেবে পেয়ে অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে এম পি বাহাউদ্দীন বাহার বলেন, আমার মেয়ের (তাহসিন বাহার সূচনা) জীবনের জন্য এটা একটা টার্নিং পয়েন্ট। আমার মেয়েও কুমিল্লার মানুষের জন্য কাজ করবে। আমারতৈরি সিটি কর্পোরেশনে (কুসিক) একজন সৎ, শিক্ষিতমেয়র দিয়েছি এর চেয়ে বড় অনুভূতি আর কিছু না।এমপি বাহার বলেন, কুমিল্লা এখন একটি যানজটের শহরেরপরিণত হয়েছে, ওয়াটার লগিংয়ের শহরে পরিণত হয়েছে। আমি এবং আমার মেয়ে যদি পরিকল্পিত ভাবে কাজ করতে পারি তাহলে কুমিল্লার মানুষ অনেক কিছু পাবে । তিনি আরও বলেন, আমার মেয়েকে (তাহসিন বাহার সূচনা) কুমিল্লা সিটি মেয়রনির্বাচিত করার মধ্য দিয়ে ১৫৭ বছরের মধ্যে একটা ইতিহাস সৃষ্টি করেছি। এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে।এদিকে কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সি.সহসভাপতি, কুমিল্লা বার এর পিপি মো. জহিরুল ইসলাম সেলিম বলেন, আমাদের নবনির্বাচিত মেয়র একবারেই সময়োপযোগী, সিটি পরিচালনায় কোন সমস্যা বা জটিলতার সম্মুখীন হলো সমাধান তাঁর কাছেই বিস্বস্ত অভিভাবক তার ঘরেই রয়েছেন। নগরবাসীর যেকোন সমস্যার সমাধান নিজ ঘরে বসেই বাবার সাথে আলোচনা করে সমাধান দিতে পারবেন।তাছাড়া তিনি কুমিল্লা এ নারী মেয়রকে নগরবাসীর জন্য একটি সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে মনে করেন।কুমিল্লার বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি জহিরুল হক দুলাল বলেন, কুমিল্লা একটি প্রাচীন শহর। এ শহরের ইতিহাস সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য অনেক সাফল্যমন্ডিত। প্রাচীন এ পৌরসভা এবং সিটি করপোরেশনে আমরা এত বছরে কোনো নারী চেয়ারম্যান বা সিটি মেয়র পাইনি। ডা. তাহসিন বাহার সূচনা শিক্ষিত নারী। তিনি দীর্ঘ ২০ বছর ধরে জাগ্রত মানবিকতা সংগঠন দ্বারা মানুষের সেবায় নিয়োজিত আছেন। তিনি একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। কুমিল্লা নগরবাসী প্রথম নগর নারী মেয়র পেয়ে খুব খুশি। তার সঙ্গে অন্যান্য প্রার্থীদের ভোটের ব্যবধান প্রমাণ করে দেয় তিনি কুমিল্লায় কতটা জনপ্রিয়।এদিকে কুমিল্লা হার্ট ফাউন্ডেশন এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. তৃপ্তীষ চন্দ্র ঘোষ তাঁর একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে বলেন, আমি খুশী। ভোটের দিনে তাঁকে ভোট দিয়েছে নগরবাসী স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে। এমন মনবিক বিনয়ী স্বভাবের এমন নারী মেয়র নগর কল্যানে আসবে। আমি বিশ্বাস করি, সূচীর এ স্বপ্নটাই জাগ্রত যে কুমিল্লাকে নতিন রূপে সাজানো এবং সেটাই হবে।সচেতন নাগরিক কমিটির সাবেক সভাপতি শাহ্ মো. আলমগীর খান বলেন, তাহসিন বাহার সূচনা একজন সমাজসেবী নারী। তাঁর সমসাময়িক কার্যক্রমে দেখা গেছে বিনয়ী সৎ ও মানবিক গুনাবলী তার রয়েছে। তাঁকে মেয়র হিসেবে পেয়ে আমরা নগরবাসী গর্বিত।বিশিষ্ট নারী নেত্রী দিলনাশি মোহসেন বলেন, ডা. তাহাসিন বাহার সূচনা একজন গুণী মেয়ে। তাঁর মতো এমন মানবিক নারী মেয়র পেয়ে আমি ব্যাক্তিগত ভাবে খুশী এবং গর্বিত।