ছবি: উপাচার্যের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রতিবাদে মানববন্ধন করেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সদস্যরা।
বিবর্তন রিপোর্ট :
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএফএম আবদুল মঈনের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ এনে আন্দোলনে আছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির শিক্ষক সদস্যরা। সাত দফা দাবিতে ১৯ মার্চ থেকে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির ডাকে টানা ক্লাস বর্জন কর্মসূচি চলছে।
এরই মাঝে ১১ শিক্ষক প্রশাসনিক দায়িত্ব থেকে স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নিয়েছেন। তবে উপাচার্যের দাবি, ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য কয়েকজন শিক্ষক এই আন্দোলন করছেন।
উপাচার্যের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ এনে গত ২০ মার্চ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি হলের হাউস টিউটর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন চার শিক্ষক। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রীড়া প্রতিনিধির দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন নৃ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান আইনুল হক। এর আগে, ৬ ফ্রেব্রুয়ারি থেকে কয়েক ধাপে প্রশাসনিক পদ থেকে অব্যাহতি নেন দুই সহকারী প্রক্টরসহ ছয় জন।
উপাচার্যের অনিয়মের প্রতিবাদ জানিয়ে মানববন্ধনও করেছেন শিক্ষক সমিতি। মানববন্ধনে উপাচার্যের নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন শিক্ষক নেতারা। তাঁরা উপাচার্যকে একজন ‘অদক্ষ’ প্রশাসক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মানববন্ধনে বক্তব্য দেন শিক্ষক সমিতির সভাপতি আবু তাহের, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাছান, শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি দুলাল চন্দ্র নন্দী, মোহাম্মদ আইনুল হক, শামিমুল ইসলাম, সাবেক সাধারণ সম্পাদক কাজী মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন, সাবেক ডিন মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন সরকার, সাবেক সিন্ডিকেট সদস্য শেখ মকছেদুর রহমান প্রমুখ
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে অনুষ্ঠিত মানববন্ধন কর্মসূচীতে , শিক্ষক সমিতির সদস্যরা বিভিন্ন লেখাসংবলিত প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়েছেন।
এ ছাড়া একটি প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘উপাচার্যের কার্যালয়ে শিক্ষকদের ওপর বর্বরোচিত হামলার বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করুন’। আরেকটিতে ‘নিয়োগ পদোন্নতির বিধিবহির্ভূত অবৈধ শর্ত বাতিল করতে হবে’। এ ছাড়া ‘পদোন্নতি বঞ্চিতদের অবিলম্বে ডিউ ডেট থেকে পদোন্নতি নিশ্চিত করতে হবে’, ‘কিশোর গ্যাং, অছাত্র ও পেটোয়া বাহিনীমুক্ত নিরাপদ ক্যাম্পাস চাই’, ‘স্বেচ্ছাচারী আচরণ বন্ধ করুন, শিক্ষকদের দাবি পূরণ করুন’, ‘মনগড়া শিক্ষাছুটি নীতিমালা বাতিল করুন’—এমন লেখাসংবলিত প্ল্যাকার্ড শিক্ষকদের হাতে দেখা যায়।
মানববন্ধনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯টি বিভাগের শতাধিক শিক্ষক অংশ নেন। শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক কাজী মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন বলেন, ‘আমি অধ্যাপক পদে এখনো স্থায়ী হতে পারিনি। উপাচার্যের অনিয়ম ও তথাকথিত শর্তারোপ শিক্ষকদের স্বাভাবিক পথচলাকে রুদ্ধ করেছে।’
মানববন্ধনে শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মো. আবু তাহের বলেন, ‘উপাচার্য তাঁর নিয়োগের শর্ত ভঙ্গ করে দুটি ইনক্রিমেন্ট নিয়েছেন। বিভাগীয় প্রধান ও ডিন নিয়োগে অনিয়ম করেছেন। জরুরি সিন্ডিকেট সভার অ্যাজেন্ডা বদলে ফেলেন। শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের শর্ত জুড়ে দেন। একগুঁয়েমি মনোভাব নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করেন। তাঁর অনুগত শিক্ষকদের জন্য সব ক্ষেত্রে শিথিলতা, সাধারণ শিক্ষকদের বেলায় শর্তারোপ করেন। উপাচার্যের দপ্তরে শিক্ষকদের ওপর হামলার ঘটনায় কোনো ধরনের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় তিনি অদক্ষ।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের জানান, শিক্ষকদের ওপর বিভিন্ন ধরনের দমন-পীড়ন, নির্যাতনসহ নানা সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হত।
নৃ বিজ্ঞান বিভাগীয় প্রধান আইনুল হক বলেন, ‘আমরা একাধিকবার আমাদের নানা প্রয়োজন, দাবি-দাওয়া উপাচার্য মহোদয়ের কাছে উপস্থাপন করলেও সেগুলো নিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে তিনি কোনো আলোচনা করেননি। কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় আজকে শিক্ষকেরা ক্লাস বর্জনের মতো এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে।’
তবে প্রশাসন ও শিক্ষকদের অপর একটি পক্ষ বলছে, নিয়ম মতোই বিশ্ববিদ্যালয় চালাচ্ছেন উপাচার্য। আর অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে উপাচার্য বলেন, সকল নিয়োগ আইন মেনেই হচ্ছে।
অন্যদিকে, কুবি ভিসি ড. মঈন ইতিবাচক ভূমিকা তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, ‘কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আসাদুজ্জামান জানান, উপাচার্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য গবেষণার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছেন। এ ছাড়া তাঁদের সঠিক মূল্যায়নের জন্য ভাইস চ্যান্সেলর স্কলারশিপ থেকে শুরু করে যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন’।
ভিসি অধ্যাপক ড. এএফএম আবদুল মঈন বলেন, ‘নিয়ম মানতে গিয়ে বা ভালো কাজ করতে যেয়ে কার কোনটা ক্ষতি হচ্ছে, কে কোন সুবিধা পেল না সেটা আমার দেখার বিষয় নয়। কারণ এখানে আমি কাজ করতে এসেছি, পপুলার ভাইস চ্যান্সেলর হতে নয়।’
শিক্ষক রাজনীতির কারণে যেন শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত না হয়, সে দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মঈন শিক্ষকদের অনিয়ম সংক্রান্ত বিষয় তুলে ধরে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদোন্নতি সাধারণত: বয়সের মানদণ্ডে নয়, মানসম্পন্ন গবেষণা ও প্রকাশনার বিবেচনায় সংগঠিত হয়ে থাকে। এছাড়া বয়সের মানদণ্ডে পদোন্নতি পায় স্কুল- কলেজ শিক্ষকরা। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যোগদান এবং বয়স বিবেচনায় পদন্নোতি চান।
তিনি বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আমি ভালো কিছু দেখি নাই। অতীতে শিক্ষক নিয়োগ এবং পদোন্নতির ক্ষেত্রে ঘুষ বানিজ্য ও দুর্ণীতি করা হয়েছে বলে আমি মনে করি। আর সেই দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধ করতে গিয়েই আমি শিক্ষকদের রোষাণলে পড়ি। স্বচ্ছতা এবং প্রতিষ্ঠানটির সার্বিক উন্নতির মান দন্ড বিবেচনায় গত দুই বছরে দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আমি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়কে ৮ নম্বরে নিয়ে আসি।
তিনি বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটি এগিয়ে নেবার জন্য আমার আরেকটা কর্ম শিক্ষকদের ভালো নাই। সেটি হলো আমি ক্লাসে ক্লাসে ঘুরে শিক্ষকদের উপস্থিতি নিশ্চয়তা বিধানের চেষ্টা করেছি। আর সেই জন্যই একটি একাডেমিক ক্যালেন্ডার তৈরি করি। আর এখনো আমি তাই চাই, আমি চাই শিক্ষকদের দাবি দাওয়ার বিষয়টিকে আলোচনার মধ্যে রেখে ছাত্রছাত্রীদের কল্যাণে শিক্ষকরা ক্লাসে ফিরে আসুক। শিক্ষকদের যেকোনো ধরনের নৈতিক দাবিদাওয়া পূরণের ক্ষেত্রে আমি সদা প্রস্তুত। নৈতিক বা অনৈতিক দাবি পূরণের প্রশ্নে কোনো শিক্ষক আমাকে আমার ব্যাক্তিগতভাবে আক্রমণ করুক এবং গালাগাল করবে, ধমক দিয়ে কথা বলবে, সেটা নিশ্চয়ই কোনো শিক্ষকের আদর্শ হতে পারে না’।
ঘটে যাওয়া একটি বিষয় আমি আলোকপাত করছি, একজন শিক্ষক যিনি বর্তমানে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের পদে রয়েছেন, তিনি তাঁর উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করার জন্য বিধি এবং প্রয়োজন অনুযায়ী দেড় বছর সময় নিতে পারতেন। নিয়েছেন ও। সে জায়গায় তিনি সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে বাড়তি আরো দেড় বছর ছুটি দাবী করেছেন এবং তা কার্যকর করার জন্য আমাকে গাল -মন্দ করেছেন। এটা কোন আদর্শবান শিক্ষকের কাজ হতে পারে না। কিন্তু তিনি তাই করেছেন।
এদিকে, কুবি শিক্ষক সমিতি সভাপতি অধ্যাপক ড. মো: আবু তাহের এবং সাধারণ সম্পাদক ড. মো: মাহমুদুল হাছান ২৬ মার্চে স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানান, স্পষ্ট ভাষায় বলছি, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় কখনোই স্থবির ছিল না বরং উপাচার্য হিসেবে ড. মঈন যোগদানের পর থেকে নানা ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, স্বজনপ্রীতি,শিক্ষকদের সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য করা, প্রশাসনিক কার্যক্রমে দীর্ঘসূত্রিতা তৈরি, নিয়োগ ও টেন্ডার বাণিজ্য, পদোন্নতি ও স্থায়ীকরণে বৈষম্য তৈরি, তথ্য গোপন করে ইনক্রিমেন্ট গ্রহণসহ নানাবিধ আর্থিক কেলেংকারীর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল ও স্থবির করে রেখেছেন। বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তাঁরা জানান, অতীতের সকল উপাচার্যই এ বিশ্ববিদ্যালয়টির জন্য বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প এনেছেন এবং ভৌত ও অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ একাডেমিক এবং প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয় টি অত্যন্ত গতিশীল ছিল । বিশেষ করে বিগত মাননীয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমরান কবির চৌধুরীর সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৬৫৫.৫০ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প এসেছে। প্রকল্পের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য ভৌত ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের কাজ বাংলাদেশের উন্নয়নের গর্বিত অংশীদার বাংলাদেশ সেনাবাহিনী-কে অর্পণ করেছেন। শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ ১৬ বছরের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার জন্য গত উপাচার্য ২০২০ সালের ২৭ জানুয়ারি ১ম সমাবর্তন সফলভাবে সম্পন্ন করেন। একদিনের জন্যও বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন অস্থিরতা ছিল না ।
বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, উপাচার্য ড. মঈন ভর্তি পরীক্ষার টাকা থেকে শিক্ষকদের অ্যাওয়ার্ড ও শিক্ষার্থীদেরকে বৃত্তি প্রদানের নামে অর্থ আত্মসাৎ, গবেষণা খাতের
বরাদ্দের তহবিল তসরুপ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কলঙ্কময় অধ্যায় রচনা করেছেন। নিয়োগের শর্ত শিথিল করে, . বিভাগীয় প্ল্যানিং কমিটির সুপারিশ অগ্রাহ্য করে এবং নিয়োগ বোর্ড সদস্যদের নোট অব ডিসেন্ট উপেক্ষা করে একাধিক বিভাগে অবৈধভাবে শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন। শিক্ষক স্বল্পতার কারণে বিভাগগুলো চলছে ধুঁকে ধুঁকে। উপাচার্য দুই বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ৭ জন শিক্ষকের পদ এনেছেন । একটি কর্মকতা-কর্মচারীর পদও তিনি নতুন করে আনতে পারেননি। শুধু তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি টাকার উন্নয়ন বরাদ্দও তিনি আনতে পারেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে সে সকল উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড চলছে, সবই আগের উপাচার্যের আমলের। উপাচার্য সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিল, স্থায়ীকরণ কমিটির সিদ্ধান্ত প্রতিনিয়ত পরিবর্তন করে কার্যবিবরণী মনগড়াভাবে তৈরি করেন । সবমিলিয়ে গত দুই বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি দৃশ্যমান কোন উন্নয়নই করতে পারেননি। এমনকি মাননীয় উপাচার্যের সময়ে ক্রীড়াক্ষেত্রে প্রথমবারের মতো বিশ্ববিদ্যালয় অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে এ দাবিও অমূলক । অতীতেও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়কে পরাজিত করে গর্বিত সফলতার স্বাক্ষর রেখেছে। প্রতিনিয়ত তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন, নিয়ম-নীতি ও বিধি-বিধানের ব্যত্যয় ঘটিয়ে যাচ্ছেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, উপাচার্য নিয়োগের প্রজ্ঞাপন নিয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে তৈরি হয়েছে নানা ধরনের বিভ্রান্তি। মাননীয় উপাচার্য ২০১১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদ থেকে অবসর নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেশন বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র প্রভাষক পদে চাকরি নিয়ে চলে যান এবং সেখানকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। দীর্ঘ ১২ বছর একই পদে চাকরি করার পর পুনরায় চাকরি নবায়ন করতে না পেরে ২০২০ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং জানুয়রি ২০২০ থেকে জানুয়ারি ২০২২ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগে চুক্তিভিত্তিক অধ্যাপক হিসেবে ৫৬,৫০০/- টাকা বেতন স্কেলে কর্মরত ছিলেন। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্তির আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে তাঁর প্রদত্ত বায়োডাটায় চুক্তিভিত্তিক কিংবা অবসরপ্রাপ্ত কথাটি তিনি উল্লেখ করেননি। ফলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক উপাচার্যের জারিকৃত প্রজ্ঞাপনটি নিয়েও নানা বিতর্ক তৈরি হয়েছে। ২০১১ সালে অবসর গ্রহণকালীন সময়ে তাঁর সর্বশেষ বেতন স্কেল ছিল ৩৪,০০০/- টাকা। প্রজ্ঞাপন অনুসারে সর্বশেষ আহরিত বেতন স্কেল ৩৪,০০০/- টাকা অথবা ৫৬,৫০০/- টাকা অনুযায়ী তার বেতন নির্ধারিত হওয়ার কথা। কিন্তু তিনি সম্পূর্ণ অবৈধভাবে ৬৮,৫৩০/- টাকা বেতন স্কেল নির্ধারণ করে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেতন-ভাতাদি গ্রহণ করছেন এবং পরবর্তীতে দুটি ইনক্রিমেন্ট যুক্ত করে বর্তমানে ৭৪,৪০০/-টাকা বেতন স্কেলে বেতন-ভাতাদি গ্রহণ করছেন। যা সম্পূর্ণরূপে বেআইনী, অনৈতিক এবং আর্থিক কেলেঙ্কারীর সামিল হিসেবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। এভাবেই মিথ্যাচারের মাধ্যমে তিনি অবৈধ বেতন-ভাতাদি গ্রহণ করে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক ক্ষতি করে যাচ্ছেন।
বিজ্ঞপ্তিতে গত ২৫ মার্চ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আবদুল মঈন ঢাকায় সাংবাদিকদের সাথে এক মতবিনিময় সভায় বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে বিভিন্ন মিথ্যাচার করেছেন বলে উল্লেখ করেছেন। সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন এক সময় স্থবির হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে তিনি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
উপাচার্য ড. মঈন এর সংবাদ সম্মেলনে উপাচার্যের বক্তব্যে বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে সাংবাদিকদের চরম মিথ্যাচার করেছেন উল্লেখ করে বলেন, তাঁর দেয়া বক্তব্য সম্পূর্ণ বানোয়াট, বিভ্রান্তিকর ও ভিত্তিহীন। উপাচার্যের এ ধরনের বক্তব্যের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যলয়ের মান সম্মান ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি উপাচার্যের এহেন বক্তব্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস পরিক্রমা ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. তাহের জানান, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে ২০০৬ সালে এবং শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর উদ্দেশ্যে ২০০৭ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রথমবারের মতো ১৫ জন শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে শুরু হয় শিক্ষা কার্যক্রম। তৎকালীন ১৫ জন শিক্ষকের মধ্যে বর্তমান ০৮ জন শিক্ষকের সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষকই মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক। ২০০৭ পরবর্তী সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও সমমনা রাজনৈতিক দলসমূহজোটের অংশগ্রহণে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার পরিচালিত হচ্ছে। এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৬৬ জন শিক্ষক এর সিংহভাগ মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লালন ও চর্চার মাধ্যমে শিক্ষা-গবেষণার উন্নয়ন এবং দেশ গঠনে অঙ্গীকারাবদ্ধ এবং এ শিক্ষকগণই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি ও বঙ্গবন্ধু পরিষদকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিকে নিরঙ্কুশ ভাবে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী নীল দলের সদস্যগণ। ২০২৪ সালের শিক্ষক সমিতিতেও নিরঙ্কুস সংখ্যাগরিষ্ঠভার মাধ্যমে নীল দল পূর্ণ প্যানেলে বিজয়ী হয়, যাদের কয়েকজন সদস্য মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। সমিতির সদস্য বিশ্ববিদ্যালয়ে গুটি কয়েক শিক্ষক প্রকাশ্যে ভিন্ন ধারার আদর্শের চর্চা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়মুক্ত বুদ্ধিচর্চার জায়গাএবংসাংবিধানিক
ভাবে রাষ্ট্রের প্রতিটি ব্যক্তি নিজস্ব রাজনৈতিক মতাদর্শ চর্চার অধিকার রাখেন বলে তিনি মনে করেন।
এদিকে ১ এপ্রিল বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি আরেকটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেন এবং তাতে উল্লেখ রয়েছে, গত ৩১ মার্চ সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে উপাচার্য উল্লেখ করেছেন,
“বিশ্ববিদ্যালযের সর্বক্ষেত্রে জামায়াতের অনুসারীদের আধিক্য রয়েছে” এবং বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে একজন উপাচার্য হিসেবে গঠনমূলক সমালোচনায় অংশগ্রহণ না করে তিনি ঢালাওভাবে শিক্ষকদের মিথ্যা কালিমালেপনের অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়েছেন এবং
শিক্ষকদের ব্যক্তিগত আক্রমণ করার মাধ্যমে শিক্ষকদের সাথে ব্যক্তিগত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হয়েছেন যা মোটেও উপাচার্যসুলভ আচরণের মধ্যে পড়ে না। শিক্ষক সমিতি মনে করে এটি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সৃষ্ট বিভিন্ন অরাজকতা ধামাচাপা দেওয়ার একটি অপপ্রয়াস । বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত সকল শিক্ষকের প্রতিনিধি হিসেবে শিক্ষক সমিতি কার্যনির্বাহী পরিষদ মনে করে মাননীয় উপাচার্য প্রত্যেক শিক্ষকের নিজস্ব রাজনৈতিক মতাদর্শ
ও বিশ্বাসকে আঘাত করেছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে উপাচার্যের সীমাহীন দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা, অব্যবস্থাপনা, নিযোগ/পদোন্নতিতে
বিধি বহির্ভূত অবৈধ শর্ত আরোপ, ইচ্ছাকৃতভাবে শিক্ষকদেরকে পদোন্নতি বঞ্চিত করা, স্থায়ীকরণ রোধ করা,আইন এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে ডিন ও বিভাগীয় প্রধান নিয়োগ, টেন্ডার বাণিজ্য, ভর্তি পরীক্ষার অর্থ আত্মসাৎ,
গবেষণা প্রকল্পের তহবিল তসরুফ, তথ্য গোপন করে অবৈধ ইনক্রিমেন্ট গ্রহণ, নিয়োগে আত্মীয়করণ, যোগ্য
প্রার্থীকে বাদ দিয়ে নির্ধারিত যোগ্যতার চেয়ে কম যোগ্যভাসম্পন্ন প্রার্থীকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ, নানাবিধ আর্থিক দুর্নীতি ও অশিক্ষকসুলভ আগ্রাসী আচরণ এর বিরুদ্ধে শিক্ষকরা তাদের যৌক্তক দাবিসমূহ আদায়ে সামষ্টিক প্রতিবাদ করে, যা এখনো চলমান। শিক্ষকদের আন্দোলনের চাপে কোণঠাসা হযে এখন তিনি মিথ্যাচারে লিপ্ত হয়েছেন।
গুণবাচক যেসকল উন্নয়ন ভিনি নিজের বলে দাবি করেন, যেমন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট নিরসন, র্যাঙ্কিং বৃদ্ধি, শিক্ষকদের গবেষণা প্রকাশনার মান বৃদ্ধি, শিক্ষার্থীদের ক্রীড়াক্ষেত্রে সাফল্য, শিক্ষার্থীদের কর্মক্ষেত্রে সফলতা- সবগুলোই মূলত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক অর্জন। এটি বিগত ১৮ বছরের সামষ্টিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা।
অবকাঠামোগত যেসকল উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে, সেগুলোর আর্থিক বরাদ্দ কোনটিই তার আমলের নয়।
অবকাঠামোগুলোর কিছু কিছুর নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে তার আমলে। বিজ্ঞান, প্রকৌশল, প্রযুক্তি, সামাজিক বিজ্ঞান বা বাণিজ্য, যে পরিসরেই গবেষণা করা হোক না কেন, ‘দু’ বছর’ পরিবর্তনের সূচনা আনতে পারে গুরত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে
পারেনা। পৃথিবীর ইতিহাসে ধর্ম, রাজনীতি, বিপ্লব, আবিস্কার বা পরিবর্তন একটি ধারাবাহিক এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। সফলতার কোনো শর্টকাট পদ্ধতি নেই। উপাচার্যের ২ বছরের উন্নয়নের ফিরিস্তি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ববর্তী অর্জনগুলোকে ম্লান করে দেয় এবং তার বক্তব্য, বিবৃতি, আলোচনা সর্বক্ষেত্রে আত্নকেন্দ্রীক যেখানে তিনি কখনোই নিজেকে ভিন্ন অন্য কাউকে স্বীকৃতি দিতে শিখেননি। যেটি মূলত নেতৃত্বের সংকট। প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে কোন অর্জন এককভাবে নয়, অর্জিত হয় সামষ্টিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে। শিক্ষক সমিতির দ্যর্থহীন ভাষায় বলতে চায়, ২০০৮ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমভাগ গ্রহণ করার পর থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত যে ৪জন উপাচার্য নিযোগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন, তাদের হাত দিয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীর প্রায় ৯০ শতাংশ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়ে উপাচার্য যে বিরুপ মন্তব্য করেছেন, এটি সম্পূর্ণরূপে মিথ্যাচার এবং ভার মনগড়া বক্তব্য। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার উপাচার্যের এখনো বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ এবং নিন্দা জ্ঞাপন করছে।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি মাননীয় উপাচার্যকে ভার ব বক্তব্য প্রত্যাহার নয়, বরং বক্তব্যের সমর্থনে আগামী সাত দিনের মধ্যে অকাট্য তথ্য প্রমাণ উপস্থাপনের আহ্বান জানাচ্ছে। প্রমাণ উপস্থাপনে ব্যর্থ হলে শিক্ষক সমিতি উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে এক দফা আন্দোলনের কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাধ্য হবে।
এদিকে, কুবি পরিসংখ্যান বিভাগের সভাপতি, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি সাবেক সভাপতি, বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, এবং সাবেক সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক ড. দুলাল চন্দ্র নন্দী বলেন, ‘বর্তমান উপাচার্য ড.মঈন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকেই অনিয়ম ও দুর্নীতির সংস্কৃতি চালু করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টিতে । একজন উপাচার্য কেমন করে শিক্ষকবান্ধবহীন হন? তাঁর সামনে শিক্ষকদের মারার জন্য তেড়ে আসা হয়। তাঁর দপ্তরে বহিরাগত ও পেটোয়া বাহিনী মাস্তানি করে। শিক্ষক হয়ে শিক্ষকদের মর্যাদা যে উপাচার্য রাখতে পারেন না, তাঁকে অদক্ষই বলতে হয়।’
এ ছাড়া তিনি জানান, ‘কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ও সমমনা শতকরা ৯৫ জন শিক্ষক উপাচার্যের কর্মকান্ডের সাথে সহমত পোষন করছেন না দাবী করে তিনি বলেন, কুবির ২৭০ জন শিক্ষকের মধ্যে শুধু মাত্র সর্বোচ্চ ২০ জন শিক্ষক ওনার প্রশাসনে অবৈধ সুবিধা নিয়ে আছেন’।