বিবর্তন রিপোর্ট :
‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়, সেকি মোর অপরাধ’ ‘বুলবুলি নীরব নার্গিস বনে, ঝরা বন গোলাপের বিলাপ শুনে’ ‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাব আমি তবু আমারে দেব না ভুলিতে’ কবি নজরুলের গান ক’খানায় কবির কবিত্বকলার এক অনুভূতির বিশাল জায়গায় সাধারন চিত্তবৃত্তি একাকার হয়ে আছে।
মহাবিদ্রোহ আর গহিন প্রেমাবলীর কালজয়ী প্রতিভার অধিকারী জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা, গল্প, গান, প্রবন্ধ, উপন্যাস আমাদের বাংলা সাহিত্য, সঙ্গীত, সংস্কৃতিকে করেছে সমৃদ্ধ। কবি নজরুলের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ কুমিল্লা। নজরুলের রাজনীতি, প্রেম, বিয়ে, ব্যক্তিজীবন, সুর সঙ্গীত ও সাহিত্যের সমুদ্রসম বর্ণিল অধ্যায় জুড়ে রয়েছে এ কুমিল্লা। কুমিল্লা শহর ছেড়ে মুরাদনগর দৌলত পুর বাসীর সাথেও কবি কাজী নজরুল ইসলামের রয়েছে আত্মিক সম্পর্ক।
কবি নজরুলের ‘বাবুদের তালপুকুরে হাবুদের ডালপকুকুরে সেকি বাস করলে তাড়া, বলি থাম একটু দাঁড়া। পুকুরের ঐ কাছে না লিচুর এক গাছ আছে না? ‘লিচু চোর ‘ এ কবিতার চরণসম্ভারে রয়েছে কুমিল্লা নগরীর বিখ্যাত ‘তালপুকুর পাড়ের’ বাসিন্দাদের হৃদয়ের রসোর্ত্তীর্ণ স্পন্দন।
সাম্য, মানবতা, প্রেম ও বিদ্রোহের কবি নজরুল ১৯২১ সাল থেকে ১৯২৩ সালের মধ্যে মোট পাঁচবার এসেছিলেন কুমিল্লায়। আর অবস্থান করেছিলেন ১১ মাস। এই দীর্ঘ অবস্থান ঘিরে নজরুলের জীবনের মোড় ঘুরার প্রেক্ষাপট এই কুমিল্লাতেই সৃষ্টি হয়েছিল। কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়র ইন্দ্রকুমার সেনের বাড়ি, ধর্মসাগর পাড়, রাণীর দীঘির পাড়, মহেশাঙ্গন, দারোগাবাড়ি, টাউনহল ময়দান, উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ শচীনদেব বর্মনের চর্থার রাজবাড়ি, নবাব বাড়িসহ কুমিল্লার আনাচে-কানাচে এবং কুমিল্লার মুরাদনগরের দৌলতপুরে তাঁর সদর্প পদচারনার অসংখ্য স্মৃতি কুমিল্লাবাসীর হৃদয়ে জেগে আছে।
কবি নজরুলের কুমিল্লায় অবস্থানের পুরো সময়টা ছিল বর্ণিল ও বৈচিত্র্যময়। কবির জীবনে কুমিল্লার মুরাদনগরের খাঁ বাড়ির নার্গিস আসার খানম আর এই শহরের পশ্চিম কান্দিরপাড়ের আশালতা সেন গুপ্তা ওরফে প্রমীলা নামের দুই নারী এসেছিলেন জীবনসঙ্গিনী হয়ে। নার্গিস ও প্রমীলা কবির জীবনে দারুণভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল। এ সময়ে তিনি কুমিল্লায় বসে অজস্র কবিতা ও গান রচনা করেছেন।
১৯২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে কুমিল্লা ঈশ্বর পাঠশালায় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা আবৃত্তি ও নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়।নজরুলকে কেন্দ্র করে কুমিল্লায় সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ১৯৪৫ সালের মাঝামাঝিতেই শুরু হয়। দেশ বিভাগের পর কুমিল্লায় ব্যাপকভাবে শুরু হয় নজরুল চর্চা।
কুমিল্লায় কবি নজরুলের অসংখ্য স্মৃতি রয়েছে। এসব স্মৃতি জাগরুক করে রাখার জন্য কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ডিগ্রী শাখায় ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কবি নজরুল ছাত্রাবাস। ১৯৬২ সালে কান্দিরপাড় থেকে ফরিদা বিদ্যায়তন পর্যন্ত সড়কটির নামকরণ করা হয় নজরুল এভিনিউ। ১৯৭০ সালে কুমিল্লায় নজরুল সাহিত্য চর্চার লক্ষ্যে গঠিত হয় নজরুল ললিতকলা পরিষদ। যা পরবর্তীতে নজরুল পরিষদ নামে রূপান্তরিত হয়। ১৯৮৩ সালে কুমিল্লা শহরের যেসব স্থানে নজরুল বিচরণ ও অবস্থান করেছিলেন সেসব স্থানে টিনের স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়। ১৯৯২ সালে ওইসব স্থানে কবি নজরুলের অবস্থান ও ঘটে যাওয়া ঘটনার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে পাকা স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়। ওই বছরে কুমিল্লা শিল্পকলা একাডেমীর সামনে নির্মিত হয় শিল্পী উত্তম গুহের তৈরী ‘চেতনায় নজরুল’ স্মৃতিস্তম্ভ। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে গবেষণা ও চর্চার জায়গাটি বেগবান করে তুলতে কুমিল্লায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নজরুল ইন্সটিটিউট কেন্দ্র। ২০০৮ সালে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজী নজরুল ইসলামের নামে ছাত্র হল প্রতিষ্ঠা হয়।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের সামনে রানীর দিঘীর পাড়ে কবিতা ও গানের আসর জমাতেন নজরুল। ২০১৩ সালের ২০ এপ্রিল কুমিল্লার ধর্মসাগরের উত্তর পাড়ে তিনতলাবিশিষ্ট নজরুল ইনস্টিটিউট কেন্দ্রের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মুরাদনগরের দৌলতপুরে নজরুল নার্গিস উচ্চবিদ্যালয় আছে। মুরাদনগর উপজেলা কমপ্লেক্স মিলনায়তনের নাম রাখা হয় কবি নজরুলের নামে। এ ছাড়া নগরের নানুয়া দিঘীর দক্ষিণ পাড়ে রয়েছে শিশুদের স্কুল নজরুল একাডেমি। রয়েছে নজরুলের নামে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক সংগঠন।
বিশিষ্ট নজরুল-গবেষক অধ্যাপক শান্তিরঞ্জন ভৌমিক বলেন, বাংলাদেশের মধ্যে কুমিল্লায় নজরুলের সৃষ্টিকর্ম বেশি। কুমিল্লা ও দৌলতপুরে কবি অজস্র গান ও কবিতা রচনা করেছেন। নজরুলকে নিয়ে আরও গবেষণার সুযোগ আছে।
কবির জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আজ সকালে কুমিল্লা জেলা শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে চেতনায় নজরুল ম্যুরালে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হয়
কবির ১২৪তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আজ কুমিল্লায় তিন দিনব্যাপী কর্মসূচি শুরু হয়েছে। এর অংশ হিসেবে জেলা শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে সকাল সাড়ে ৯টায় চেতনায় নজরুল ম্যুরালে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হয়। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে নজরুলের আলোকচিত্র ও পুস্তক প্রদর্শনী, ‘অগ্নিবীণার শতবর্ষ: বঙ্গবন্ধুর চেতনায় শাণিত রূপ’ প্রবন্ধের ওপর আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আগামীকাল দৌলতপুরে ও ২৭ মে বিকেলে জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও পুরস্কার বিতরণ করা হবে।
জাতীয় কবি নজরুলের সামগ্রিক জীবনের অস্তিত্ব নি:সন্দেহে কুমিল্লা কেন্দ্রিক। নজরুল কুমিল্লার, কুমিল্লা নজরুলের। এই বোধ ও বিশ্বাসের জায়গাটি অনেক সমৃদ্ধ হয়ে ওঠেছে নজরুল প্রেমিদের সাহিত্য চর্চা ও বিভিন্নভাবে কবি নজরুলের অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্যদিয়ে।
১৮৯৯ সালের এই দিনে ভারতের আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম। ১৯৭৬ সালের ২৭ আগস্ট তিনি মারা যান।