ছবি: তাঁতে খাদি কাপড় বুনছেন তাঁতি রনজিৎ দেবনাথ।
বিবর্তনডেক্স :
কুমিল্লার খাদি। এক নামেই খ্যতি রয়েছে দেশজুড়ে।একসময় বৃহত্তর কুমিল্লা অঞ্চলে হাজারো তাঁতি খাদি কাপড়ের সরবরাহের সঙ্গে জড়িত থাকলেও এখন টিকে আছে মাত্র ৮টি তাঁত।
দক্ষ কারিগর, প্রশিক্ষণ, সংরক্ষণ ও যথাযথ বাজারজাতকরণের অভাবে দিন দিন ছোট হয়ে আসছে কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী পণ্য খাদির বাজার। তাঁতের তৈরি খাদিতে এখন লেগেছে মেশিনের ছোঁয়া। হাতে বোনা তাঁতের আসল খাদি এখন বিলুপ্তির পথে। শুরুর দিক বিবেচনায় বর্তমানে যে গুটিকয়েক তাঁত টিকে আছে তা সহজেই বলা যায় । আর এতেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে খাদির দৈন্যতা।
সমাজ সচেতনরা বলছেন, তাঁতের আসল খাদির চাহিদা আছে সবসময়ই, তবে কাঁচামালের অভাবে বিলুপ্তপ্রায় তাঁতের খাদি ফিরিয়ে আনতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। শেষ প্রজন্মে তাঁতের দক্ষ কারিগর যারা টিকে আছেন তাদের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ ও সংরক্ষণ ব্যবস্থা করা গেলে মসলিনের চেয়েও সহজে খাদির উত্তরণ সম্ভব বলে মনে করেন তারা।
কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার, চান্দিনা ও মুরাদনগর উপজেলা থেকে তাঁতে তৈরি খাদি কাপড় একসময় সুনাম অর্জন করে অবিভক্ত ভারতবর্ষসহ সারা বিশ্বে। বাংলাদেশের পোশাকের ব্র্যান্ড হিসেবে কুমিল্লার খাদির কদর এখনো কমেনি। তবে কালের বিবর্তনে কারিগরের হাতে তাঁতের তৈরি আসল খাদি এখন বিলুপ্তির পথে।
শেষ প্রজন্মের দুই -একজন তাঁতির দেখা মেলে খাদির এক সময়ের প্রথম সারির আদিপত্যে থাকা কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার বড়কামতা গ্রাম। বংশপরম্পরায় আসল খাদির কারিগর দেবিদ্বার এই বড়কামতা গ্রামের চিন্তাহরন দেবনাথ ও রণজিৎ দেবনাথ। ৭০ এর দশক থেকেই খাদির সুতা ও কাপড় তৈরিতে জড়িত তারা। সত্তোরোর্ধ্ব এই দুজন সম্পর্কে ভাই। তাঁদের এই গোষ্ঠীর মাধ্যমেই কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় খাদির তাঁতের কারিগররা ছড়িয়ে পড়েন বলে দাবি করছেন তাঁরা।
আসল খাদির এই তাঁতিরা জানালেন, এই অঞ্চলে একসময় হাজার হাজার তাঁত থেকে সারা দেশে খাদির কাপড় সরবরাহ করা হতো। তুলা আর দক্ষ কারিগরের অভাবে এখন আর তাঁতের খাদি নেই। মেশিনে তৈরি খাদি পরেই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাচ্ছে সবাই।
তাঁতি চিন্তাহরন দেবনাথ তাঁর গবেষণা চিন্তাভাবনা থেকে বলেন, মেশিনে বানানো খাদি আর তাঁতের খাদি দেখতে একই রকম কিন্তু মানের অনেক তফাৎ। যারা আসল খাদি চিনে তারা সেটি খুঁজেই কিনে নিয়ে পরেন। তাঁতের খাদি দিয়েই কুমিল্লার খাদি বিশ্বের সম্মান পায় আর এখন সেই তাঁতই বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। কুমিল্লাতে তিনটি দোকানে পাওয়া যায় আসল খাদি। তাও খুব কম পরিমাণে। একসময়ে যে এলাকাগুলতে প্রায় ঘরেই তাঁত ছিল কিন্ত এখন সেই গ্রাম গুলোতে খাদি বুনার এখন আর তাঁত নেই।
চিন্তাহরন দেবনাথ আরও জানান, একসময় কুমিল্লার দেবিদ্বার, চান্দিনা ও মুরাদনগর এলাকায় হাজার হাজার তাঁতি ছিল। নারীরা চরকায় খাদির সুতা কেটে আয় করত। পরিবারের ভরণপোষণ চলত সচ্ছলভাবে। কুমিল্লা থেকে সারা দেশ তথা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে খাদির পোশাক রপ্তানি হতো। আর এখন উপজেলায় তাঁত খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
রণজিৎ দেবনাথের ছিল ৮টি তাঁতের একটি ছাড়া সবই বন্ধ। শখের বশে দুই–এক থান বুনেন তিনি। তাঁতে বসেই জানালেন, খাদির প্রজন্ম এখন প্রায় শেষপর্যায়ে।
এদিকে , কুমিল্লা সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় কুমিল্লা খাদি কাপড়ে সরবরাহকারী চান্দিনা সজল খদ্দর বস্ত্র নিকেতনএর স্বত্বাধিকারী শংকর দেবনাথ জানান, এক সময়ে তাদে এটা পেশা ছিল। বর্তমানে তাঁর ৭/৮ টি তাঁত রয়েছে, এ গুলি দিয়ে খাদি কাপড় উৎপাদন হয়। অন্যদের দিয়ে তিনি কাজ করান। এ ছাড়াও বর্তমানে চান্দিনা সহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় তাঁত এর বদলে মেশিনে একই ভাবে কিছুটা কমশ্রম মূল্যে খাদি কাপড় উৎপাদন করা হয়। মেশিনগুলোর বাজার মূল্য ৪০- ৫০ হাজার টাকা হয়ে থাকে শংকর জানান।
পুরুষ এবং মহিলা তাঁতিদের নিজের সংগৃহীত মেশিনে কাপড় বুনেন তাঁরা। তিনি সুতা সরবরাহ ক’রে তাদের মজুরী দিয়ে খাদি কাপড় সংগ্রহ করে বাজারে সরবরাহ করেন বলে জানান তিনি। এ ব্যবসায় বেশ সফল এবং লাভবান বলেও জানান তিনি।
তিনি আরো জানান, বাজারে হাতের তৈরী তাঁতের খাদি কাপড়ের তুলনামূলক বেশী চাহিদা থাকলেও হাতের তৈরী তাঁত মেশিনে কাজ করতে আগ্রহী শ্রমিক পাওয়া যায় না এখন।
সচেতন মহল বলছেন, এখনই কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী এই খাদি উত্তরণে পদক্ষেপ না নেওয়া হলে আসল খাদির সুতা কাটা ও বুনন হারিয়ে যাবে। তুলা সরবরাহ করা গেলে আর সুতার কাটার কারিগরদের ভর্তুকি দিয়ে মজুরির ব্যবস্থা করা গেলেই আবারও জোয়ার আসবে আদি খাদির। তাঁতের খাদির দাম বেশি হলেও চাহিদা আছে। খাদি বলে মেশিনে তৈরি কাপড় বিক্রি প্রতারণার শামিল।
তাঁতি রণজিৎ দেবনাথের দাবি, খাদি শুধুমাত্র কুমিল্লা অঞ্চলের কাপড়। আদিকাল থেকেই এই অঞ্চলের মানুষ কাপড় তৈরির যে পেশাদার সংস্কৃতি চালু করেছিল তারই একটি অংশ খাদি। মহাত্মা গান্ধীর স্বদেশি আন্দোলনের সময় তা প্রসার পায়। কুমিল্লার খাদি এবং ভারতীয় খাদির মধ্যে বুননে পার্থক্য আছে। কুমিল্লার খাদি শুধু কুমিল্লারই। কুমিল্লার বিশুদ্ধ খদ্দর ভাণ্ডার, খাদি ভবন, খাদি ভূষণসহ কয়েকটি দোকানে পাওয়ায় যায় হাতে তৈরি আসল খাদি। এসব খাদি কাপড় মানে যেমন অনন্য তেমনি দামেও বেশি। তারপরও তাঁতের আসল খাদির চাহিদা মেশিনের খাদির চেয়ে বেশি বলেই মনে করেন সৌখিন খাদি ক্রেতা ও দোকানিরা।
তাঁতে বুনা আসল খাদি কাপড়ের চাহিদা সম্পর্কে জানতে খাদি কাপড়ের কুমিল্লার পুরাতন এক ব্যবসায়ী আজিমুল আলম আজম জানান, বিগত কয়েক বছর ধরে কাস্টমারদের মধ্যে কুমিল্লার আসল খাদি কাপড়ের চাহিদা বেড়ে চলেছে। স্থানীয় কাস্টমারদের চেয়ে এ চাহিদা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা অর্থাৎ কুমিল্লার বাহিরের কাস্টমারদের তুলনামূলক বেশী। চিকন সুতার তৈরী ‘স্ল্যাব খদ্দর ‘ মোটা সুতার তৈরী খাদি কাপড়কে বলা হয় ‘বাপতা খদ্দর। এর মধ্যে ‘স্ল্যাব খদ্দর’ কাপড়ের তৈরী পোষাকের মূল্য ও বেশী, চাহিদাও বেশী।
কুমিল্লার ইতিহাসবিদদের মতে, ভারতীয় উপমহাদেশের কুমিল্লার তাঁতের খাদি এই অঞ্চলের একটি মৌলিক পণ্য যা সারা বিশ্বে সুনাম অর্জন করে। ঐতিহ্য হিসেবে মসলিনের মতোই খাদিকে পুনরুদ্ধার করা প্রয়োজন।
‘খাদি শুধু কাপড় কিংবা পোশাক নয়, এটি দেশপ্রেমের অনবদ্য দলিলও। বহুকাল আগেও যে কুমিল্লা অঞ্চল একটি সমৃদ্ধ জনপদ ছিল— তার প্রমাণ। সরকার চাইলেই মসলিনের মতো প্রকল্পভিত্তিক উন্নয় কার্যক্রম হাতে নিয়ে খাদির উত্তরণ ঘটাতে পারে।’— বললেন লেখক গবেষক আহসানুল কবির।
কুমিল্লা জেলা প্রশাসক খন্দকার মু. মুশফিকুর রহমান জানান, কুমিল্লার আসল খাদি কাপড়কে পুনরুদ্ধারের বিষয়টি পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়কে গুরুত্বের সঙ্গে জানানো হবে। এছাড়া কুমিল্লার খাদির ভৌগলিক স্বত্ব জিআই স্বীকৃতির জন্য আবেদন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ আব্দুর রউফ বলেন, তাঁত শিল্পের উন্নয়নে বিভাগীয় পর্যায় ছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় প্রয়োজন সংখ্যক সার্ভিস সেন্টার রয়েছে যেমন কুষ্টিয়াতে কাজ চলছে, তাঁতিদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করে থাকে। যেমন স্বল্প খরচে সুতার রং করা এবং তাঁতিদের পরামর্শ দেয়া এই সার্ভিস সেন্টারের কাজ।। তাছাড়া কোন জেলা বা উপজেলাসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলের তাঁতিরা ব্যক্তিগতভাবে বা দলীয় ভাবে বা কোন সমিতির মাধ্যমে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সহ আমাদের যে তাঁত বোর্ড রয়েছে সেখানে যোগাযোগ করলে সরকারি প্রনোদনা সহ এই শিল্পের উন্নয়নে বিভিন্ন রকমের দিকনির্দেশনা নিয়ে যেতে পারে। সে সুযোগ যেমন একটি তাঁতি সমিতির রয়েছে, তেমনি একজন তাঁতি তাঁর সমস্যা নিয়ে সহযোগিতার পেতে আসতে পারে। আমরা তাঁতিদের সমস্যাসমাধান, মূল্যায়নসহ সবধরনের সহযোহিতা করতে সর্বদা সচেষ্ট রয়েছি।
তিনি আরো বলেন, কুমিল্লাতে ঐতিহ্যবাহী খাদি কাপড় তৈরীতে এই হস্তশালিত তাঁত শিল্পের আধুনিকায়নে যেতে তাঁতিদের আটকে রাখা যাবে না। খাঁটি আদি খাদি কাপড় তৈরিতে ঐতিহ্যবাহী হস্ত চালিত তাঁত যন্ত্রের গুরুত্ব রয়েছে বটে কিন্তু বর্তমানে এই শিল্পে হাতে কাজ করে যথার্থ মজুরি পাওয়া কঠিন বলে এই শিল্পীরা আধুনিক যন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে । তবে এ হস্তচালিত পদ্ধতি ধরে রাখার জন্য আমাদের দেশে তাঁতিদের প্রনোদনার সুযোগ রয়েছে। তবে চাহিদা নিয়ে আমাদের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।
এদিকে, বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের নব নিযুক্ত চেয়ারম্যান মোঃ মাহমুদ হোসেন জানান, এ পদে আমি যোগদানের পর থেকে কুমিল্লা যাওয়া হয়নি। ঐতিহ্যবাহী কুমিল্লা খাদির দীর্ঘদিনের সুখ্যাতি রয়েছে, এটা সবার জানা । দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁতিদের যে সমিতিগুলো রয়েছে তাঁরা আমাদের সাথে যোগাযোগ রেখে চলেছেন। আমার জানা মতে কুমিল্লাতে এ ধরনের সমিতি নেই বলে আমাদের সাথে যোগাযোগটা হয়ে উঠছে না। ব্যক্তিগতভাবে বা সমিতির মাধ্যমেই এ পর্যন্ত কোন তাঁতি যোগাযোগ করে নি।
দেশের বিভাগীয় পর্যায়সহ বিভিন্ন এলাকায় বেশ কয়েকটি সার্ভিস সেন্টার থাকলেও আমার জানা মতে কুমিল্লাতে সেটি স্থাপন হয়নি। এ পদে সদ্য যোগদান করেছি বলে আসলে বিষয়গুলো সম্পর্কে আমি বিস্তারিত জানাতে পারছি না।
চাহিদা অনুযায়ী কুমিল্লা সহ দেশের আরো কয়েক জায়গায় সার্ভিস সেন্টার খোলা সহ প্রনোদনার সুযোগসুবিধা বাড়ানোর ক্ষেত্রে বোর্ডের পরিকল্পনা রয়েছে কিনা তাঁত বোর্ডের এ চেয়ারম্যান মহোদয়ের কাছে জানতে আবারো মুঠোফোনে যোগাযোগ করতে গেলে দীর্ঘসময় ফোনটি ব্যাস্ত পাওয়া যায়।
তাঁত হচ্ছে এক ধরনের যন্ত্র যা দিয়ে তুলা বা তুলা হতে উৎপন্ন সুতা থেকে কাপড় বানানো যায়। তাঁত বিভিন্ন রকমের হতে পারে । খুব ছোট আকারের হাতে বহন যোগ্য তাঁত থেকে শুরু করে বিশাল আকৃতির স্থির তাঁত দেখা যায়। আধুনিক বস্ত্র কারখানা গুলোতে স্বয়ংক্রিয় তাঁত ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
একজন অসমীয়া মহিলা তাঁত ব্যবহার করছেন
একজন হাঙ্গেরীয়ান মহিলা তাঁত ব্যবহার করছেন
সাধারণত তাঁত নামক যন্ত্রটিতে সুতা কুণ্ডলী আকারে টানটান করে ঢুকিয়ে দেয়া থাকে । লম্বালম্বি সুতাগুলিকে টানা এবং আড়াআড়ি সুতাগুলিকে পোড়েন বলা হয়। যখন তাঁত চালু করা হয় তখন নির্দিষ্ট সাজ অনুসারে সুতা টেনে নেয়া হয় এবং সেলাই করা হয়। তাঁতের আকার এবং এর ভেতরের কলা কৌশল বিভিন্ন রকমের হতে পারে। বাংলা তাঁত যন্ত্রে ঝোলানো হাতল টেনে সুতো জড়ানো মাকু(spindle) আড়াআড়ি ছোটানো হয়। মাকু ছাড়াও তাঁতযন্ত্রের অন্যান্য প্রধান অঙ্গগুলি হল – শানা, দক্তি ও নরাজ । শানার কাজ হল টানা সুতার খেইগুলিকে পরস্পর পাশাপাশি নিজ নিজ স্থানে রেখে টানাকে নির্দিষ্ট প্রস্থ বরাবর ছড়িয়ে রাখা। শানার সাহায্যেই কাপড় বোনার সময় প্রত্যেকটি পোড়েনকে ঘা দিয়ে পরপর বসানো হয়। শানাকে শক্ত করে রাখার কাঠামো হল দক্তি। একখানি ভারী ও সোজা চওড়া কাঠে নালী কেটে শানা বসানো হয় আর তার পাশ দিয়ে কাঠের উপর দিয়ে মাকু যাতায়াত করে। শানাটিকে ঠিক জায়গায় রাখার জন্য তার উপরে চাপা দেওয়ার জন্য যে নালা-কাটা কাঠ বসানো হয় তার নাম মুঠ-কাঠ। শানা ধরে রাখার এই দুখানি কাঠ একটি কাঠামোতে আটকে ঝুলিয়ে রাখা হয় । এই সমগ্র ব্যবস্থাযুক্ত যন্ত্রটির নাম দক্তি ।
শানায় গাঁথা আবশ্যকমত প্রস্থ অনুযায়ী টানাটিকে একটি গোলাকার কাঠের উপর জড়িয়ে রাখা হয়, একে বলে টানার নরাজ । আর তাঁতি যেখানে বসে তাঁত বোনে , সেখানে তার কোলেও একটী নরাজ থাকে- তার নাম কোল-নরাজ । টানার নরাজের কাজ হল টানার সুতাকে টেনে ধরে রাখা আর কোল-নরাজের কাজ হল কাপড় বোনার পর কাপড়কে গুটিয়ে রাখা ।
“তাঁত বোনা” শব্দ কটি এসেছে “তন্তু বয়ন” থেকে। তাঁত বোনা যার পেশা সে হল তন্তুবায় বা তাঁতী। আর এই তাঁতের উপর যারা বিশেষ কৌশল প্রয়োগ করে তাদেরকে ফেব্রিক ইঞ্জিনিয়ার বলা হয়।
হস্তচালিত তাঁত শিল্প বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ কুটির শিল্প। জাতীয় অর্থনীতিতে তাঁত শিল্পের ভূমিকা অপরিসীম। ২০১৮ সালের তাঁত শুমারি অনুযায়ী তাঁত শিল্পে বছরে ৪৭.৪৭৪ কোটি মিটার কাপড় উৎপাদিত হয়, যা দেশের বস্ত্র চাহিদার প্রায় ২৮ ভাগ পূরণ করে থাকে। জাতীয় অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজনের দিক দিয়ে তাঁত শিল্প খাতের অবদান ২২৬৯.৭০ কোটি টাকা। জিডিপিতে তাঁত শিল্প খাতের অবদান ০.১০%। বর্তমানে এ শিল্পের সাথে তাঁতিসহ প্রত্যক্ষভাবে প্রায় নয় লক্ষ লোক নিয়োজিত রয়েছে। এছাড়াও ডিজাইনার, তাঁত ব্যবসায়ী, তাঁত উদ্যোক্তা, তাঁতে সুতা, রং ও রসায়ন সরবরাহকারী, আমদানি ও রপ্তানিকারকসহ বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠী পরোক্ষভাবে এ শিল্পের সাথে জড়িত রয়েছে। ফলে কর্মসংস্থানের দিক দিয়ে এর স্থান কৃষি ও গার্মেন্টস শিল্পের পরেই তৃতীয় বৃহত্তম এবং গ্রামীণ কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে কৃষির পরে দ্বিতীয় বৃহত্তম। গ্রামীণ কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এবং মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে তাঁত শিল্পের ভূমিকা অনন্য। ২০১৮ সালে দেশব্যাপী পরিচালিত তাঁত শুমারি অনুযায়ী দেশে বিদ্যমান ১,১৬,১১৭টি তাঁত ইউনিটে মোট হস্তচালিত তাঁতের সংখ্যা ২,৯০,২৮২টি। তন্মধ্যে চালু তাঁতের সংখ্যা ১,৯১,৭২৩টি এবং বন্ধ তাঁতের সংখ্যা ৯৮,৫৫৯টি। বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড হতে প্রকাশিত মাসিক/বার্ষিক ব্যবস্থাপনা তথ্য প্রতিবেদনে তাঁত শিল্পের তথ্য, এ শিল্পের সার্বিক কর্মকান্ড এবং বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের অধীনে পরিচালিত প্রকল্প এবং প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যক্রমের বিবরণ সন্নিবেশ করা হয়। প্রতিবেদনে সন্নিবেশিত তথ্য উপাত্ত তাঁত শিল্পের উন্নয়ন ও ভবিষ্যৎ কার্যক্রম গ্রহণে সহায়ক হবে।
১৯২০ সালে মহাত্মা গান্ধীর স্বদেশী আন্দোলনে বিলেতি পণ্য বর্জনের ডাকে খাদি কাপড় ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। তবে গবেষকদের দাবি, সপ্তাদশ শতাব্দী থেকেই তৎকালীন ত্রিপুরার অংশ বর্তমান কুমিল্লা অঞ্চলের মানুষ খাদি কাপড় তৈরি করে নিজেদের চাহিদা মেটাতেন।